মীরজাফর নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক বিশ্বাসঘাতকের চিত্র।
পলাশী প্রান্তরের লড়াইয়ের পর ২৬৫ বছর কেটে গেছে। তবু মীরজাফর নামটি সমান ভাবে ঘৃণিত হয় মানুষের কাছে।
মীরজাফর আলী খান ১৬৯১ সালে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত। তার প্রভু আলীবর্দি খানের সাথে ভাগ্যান্বেষনে ভারতে এসেছিলেন।
পরবর্তীতে আলীবর্দি খান নবাব হয়ে, সৎ বোন শাহ খানমেট এর সাথে, মীরজাফরের বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সাথে তাকে নবাবের পরবর্তী সম্মানজনক পদ , বখশী প্রদান করা হয়েছিল।
কিন্তু মীরজাফর ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং কূটবুদ্ধির লোক। তিনি ১৭৪৬ সালে মারাঠাদের পরাজিত করে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। কিন্তু পরের বছরই লড়াইয়ের ময়দান থেকে পালিয়ে চলে আসেন।
তখন থেকেই আলীবর্দি খানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চক্রান্ত শুরু করেন তিনি। এমনকি পুর্নিয়ার শাসক শওকত জংকে বাংলা আক্রমণ করারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এইসব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।
আলীবর্দি খানের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেন। সেই সময়ে মীরজাফর কৌশলে দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার সুবাহদারির ফরমান নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
শেষমেশ নবাবকে ক্ষমতা থেকে সরাতে তিনি ইংরেজদের সাথে হাত মেলান।
১৭৫৭ সালের এপ্রিল মাসেই তিনি ইংরেজদের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এবং পরের মাসেই তাদের সাথে করা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
মীরজাফরকে বাংলা বিহার এবং উড়িষ্যার নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসানোর প্রতিশ্রুতি দেয় ইংরেজরা।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর লড়াই শুরু হলে নবাবের সেনাবাহিনীতে বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষ্মণ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
কারণ মীরজাফর শুরু থেকেই তার কূট বুদ্ধি দিয়ে সেনাবাহিনীকে নানা দলে বিভক্ত করে ফেলেছিল।
নবাব যখন তার তাঁবুতে গিয়ে আনুগত্য ও সহযোগিতা চান, তখন তিনি নবাবকে মিথ্যা আশ্বাস দেন।
তিনি সেদিনের লড়াই বন্ধ করে দিতে বলেন। পরের দিন তিনি নিজে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিবেন বলেও আশ্বস্ত করেন।
কিন্তু সেই ময়দানেই মীরজাফর ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভকে সব তথ্য জানিয়ে নবাবের বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে বলেন৷
এর ফলে ইংরেজদের কাছে শোচনীয় পরাজয় ঘটে বাংলার। নবাবের করুণ পরিনতি বরণ করতে হয়।
পলাশীর পর ২৯ জুন মীরজাফরকে নবাবের সিংহাসনে বসায় ইংরেজরা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন ইংরেজদের হাতের পুতুল। তাকে ক্ষমতায় রেখে অবাধে লুট ও বাণিজ্য চালিয়েছিল তারা।
তাঁকে দিয়ে স্বার্থউদ্ধার না হওয়ায় ১৭৬০ সালেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তারই জামাতা মীর কাশিমকে ক্ষমতায় বসায় ইংরেজরা। মীর কাশিম ছিলেন স্বাধীনচেতা।
তার সাথে বনিবনা হয়নি ইংরেজদের। তাই ১৭৬৩ সালে আবারও মীরজাফরকে ক্ষমতায় বসানো হয়।
১৭৬৫ সালে পৃথিবী ত্যাগ করেন মীরজাফর। এর আগ পর্যন্ত তিনি নবাব ছিলেন। ঐ সময় কুষ্ঠ রোগ আর আফিমে আসক্ত ছিলেন তিনি।
অত্যন্ত করুণভাবে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাকে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে তার সমাধি রয়েছে।
এত বছর পরেও ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ভুলে যায়নি। তার কারণেই দুইশত বছর ইংরেজদের গোলামী সহ্য করতে হয়েছিল।
গত বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মীরজাফরের বংশধরদের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল।
তার বংশধরদের মতে মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না। সে-সময় তিনি শুধু তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারা মীরজাফরকে নিয়ে মোটেই লজ্জিত নন।
কিন্তু তাদের এই দাবির যথাযথ সত্যতা প্রমাণিত হয়নি এখনও। তাই ইতিহাসের পাতায় আর মানুষের মনের খাতায় মীরজাফর সব সময় একজন বিশ্বাসঘাতক হয়েই টিকে থাকবেন।