স্বামী যখন অন্য নারীকে বিয়ে করে সুখে ঘরকন্না করার স্বপ্ন দেখছে, দূর্ঘটনায় সর্বস্ব হারানো মেয়েটি তখন হাসপাতালের বিছানায় ছটপট করছিলো।
মাত্র একটা দূর্ঘটনাই মুনিবার জীবনের সবকিছু কেড়ে নিয়েছিলো। এমন দুঃসহ পরিস্থিতি কাটিয়ে কিভাবে আজ "পাকিস্তানের লৌহমানবী" হলেন মুনিবা মাজারি? চলুন জেনে নেই সেই সংগ্রামী জীবনের গল্প।
ছোটবেলা থেকে চিত্রশিল্পী হবার স্বপ্ন ছিলো মুনিবার। তবে সে স্বপ্নকে মাটিচাপা দিতে হয় বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকে।
তাদের কথা মেনে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মুনিবা। তার স্বামী পাকিস্তানি পাইলট খুররাম শাহাজাদ।
তবে বিয়ের পরই শুরু মুনিবার জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়ের। স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের ছিলোনা তার। তবুও মুখ বুঝে কোনোরকমে কাটিয়ে দিচ্ছিলেন দিনগুলো।
কিন্তু বিয়ের মাত্র দু' বছরের মাথায় স্বামীসহ এক সড়ক দুর্ঘটনার স্বীকার হন মুনিবা। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন মুনিবার স্বামী।
তবে দূর্ভাগ্যবশত গাড়িতে আটকা পড়ে যান মুনিবা। আহত হন মারাত্মকভাবে। দুর্ঘটনার পর দেহের নিচের অংশটা পুরই অকেজো হয়ে গিয়েছিল মুনিবার।
আল্লাহর কৃপায় জীবন রক্ষা পেলেও, পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হয় তাকে। এমনকি আঘাত প্রাপ্ত হয়ে তার একটি হাতও পুরো অকেজো হয়ে যায়।
জীবনের নিষ্ঠুরতা তার এখানেই শেষ নয়, এরপর সবচেয়ে দুঃখজনক কথাটি শুনতে হলো মুনিবাকে। আর তা হলো মুনিবার পক্ষে আর কখনো মা হওয়াও সম্ভব নয়৷
কথাটা শুনে একেবারে ভেঙে পড়েন তিনি। নিজের জীবন শেষ করার কথাও ভাবেন। কিন্তু সাহস যোগান তার মা। মায়ের অনুপ্রেরণায় আবারও বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
করাচি হাসপাতালে থাকতে হয় টানা আড়াই মাস। জীবনের সবচেয়ে দুঃস্বপ্নের এ সময়টাতে মুনিবা পাশে পাননি তার স্বামীকে।
সান্ত্বনা বাক্য তো দূরের কথা, তাকে দেখতেও আসেন নি হাসপাতালে। বরং অসহায় অবস্থায় স্ত্রীকে ফেলে অন্যত্র বিয়ে করেন তিনি।
অবশ্য স্বামী অনত্র বিয়ে করেছেন জেনে অন্য আর দশটা সাধারণ নারীর মতো ভেঙে পড়েন নি মুনিবা। বরং স্বার্থপর স্বামীকে ভুলে জীবনকে নতুন করে গড়ার শুরুটা করছিলেন সেদিনই।
তার স্বামী যখন অন্য নারীকে বিয়ে করে ঘর বাঁধতে চলছিলো, মুনিবা তখন নিজের স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দেবেন বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন।
যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। ভাইকে বলে সেদিনই ক্যানভাস আর রংতুলি আনেন। আঁকতে শুরু করেন হাসপাতালের বেডে শুয়েই! প্রথমে তুলির আঁচরে হসপিটালে বেডে শুয়ে থাকা নিজের অসহায় ছবিটিই আঁকেন মুনিবা।
শুরু হয় তার একাকী জীবন সংগ্রাম। দূর্ঘটনা কেবল তার নিঃস্বই করেনি, বরং জীবনকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছিলো।
আত্মমর্যাদাশীল মুনিবা করুণার ও অবহেলার পাত্রী হয়ে বেচে থাকতে চাননি। তাই ডিভোর্স দেন স্বামীকে৷
মা হতে না পারার বেদনাকে মেনে নিয়ে অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেন এক সন্তান৷ যার নাম রাখেন নীল মাজারি।
ধীরে ধীরে মুনিবা তার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী শুরু করেন। এর পাশাপাশি অনলাইন পোর্টালে লেখক হিসেবেও কাজ শুরু করেন।
একই সঙ্গে হুইল চেয়ারে বসা চিত্রশিল্পী হিসেবে চারদিকে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। ফলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী উঠেন।
এরপর ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় তৈরি করেন মুনিবা। শুরু করেন মডেলিং দিয়ে। ‘পন্ডস’ ‘টনি অ্যান্ড গাই’সহ আরও অনেক কোম্পানির অ্যাম্বাসেডর হিসেবে যোগ দেন।
সফলতাও ধরা দেয় তার কাছে। পাকিস্তানের মতো একটি রক্ষণশীল দেশে হয়ে উঠেন শীর্ষ মডেল।এছাড়া হুইল চেয়ারে বসা ব্যক্তি হিসেবে প্রথম টিভিতে উপস্থাপনাও করেন তিনি।
২০১৫ সালে বিবিসি’র সেরা ১০০ নারীর তালিকায় চলে আসে তাঁর নাম৷ ২০১৬ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনেও নাম আসে তাঁর৷
এরই মধ্যে ‘মুনিবাস ক্যানভাস’ নামে নিজস্ব একটি ব্র্যান্ডও তৈরি করেছেন। এ ব্র্যান্ডেরর বার্তা ‘লেট ইয়োর ওয়ালস ওয়্যার কালারস’।
মুনিবা এখন পাকিস্তানের ইউএন ওম্যানের শুভেচ্ছাদূত। পাশাপাশি জনপ্রিয় একজন মোটিভেশনাল স্পিকারও বটে! তাঁর দেয়া বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্যবার শেয়ার হয়েছে৷
হুইল চেয়ারে বসেই বিশ্বকে জয় করা এ নারী ১৯ মে ২০১৮ সালে রোবোটিক্স সাপোর্ট সিস্টেমের মাধ্যমে দশ বছর পর প্রথম নিজ পায়ে দাঁড়ান।
বর্তমানে নিজের ছেলে আর পরিবারকে নিয়ে বেশ ভালোই আছেন এ আয়রন লেডি। পুরোদমে ছবি আঁকা, সামাজিক সেবামূলক কাজ, মডেলিং ও উপস্থাপনা করে চলেছেন। পাশাপাশি গানও গাইছেন।
জীবন তার সামনে এনে দিয়েছিল পাহাড় সমান বাধা, অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও কষ্ট। কিন্তু জীবনের সে কঠিন বাস্তবতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন সামনের দিকে।
তাই তো পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা উৎস হয়ে উঠেছেন জীবন যুদ্ধে হার না মানা এই নারী৷ তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে কি করে অসাধ্যকেও সাধন করা যায়।