অন্যান্য

এক শার্ট ৩০ বছর পরেছেন ডা. জাফরুল্লাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩
এক শার্ট ৩০ বছর পরেছেন ডা. জাফরুল্লাহ
যুক্তরাজ্যের বর্তমান রাজা, তৎকালীন প্রিন্স চার্লস যে টেইলারে স্যুট তৈরী করতেন, সেই রাজকীয় টেইলার্সে স্যুট বানাতেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
 দর্জি বাসায় এসে মাপ নিয়ে স্যুট তৈরি করতেন বলে, পরিশোধ করতে হতো অতিরিক্ত ২০ পাউন্ড। 

অথচ সেই জাফরুল্লাহ চৌধুরীই পরবর্তী সময়ে এক শার্টে পার করে দিয়েছেন ৩০ বছর। সাদা ও হালকা বেগুনি চেকের সেই শার্টের বিষয়ে ,২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এক সাংবাদিককে জানান, ওই শার্ট তিনি ৩০ বছর ধরে পরে আসছেন।এছাড়া আলাপ চলাকালে, তার পরনের প্যান্ট, তালি দেওয়া বলেও দেখানো হয়। প্যান্ট ছিড়ে গেছে বলে, তাতে তিনি তালি লাগান। 

জীবদ্দশায় এমনই সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে তিনি বেছে নিয়েছিলেন অতি সাধারণ বেশভূষা।অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী এই ব্যক্তি, ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম নেন। দশ ভাইবোনের মাঝে তিনি ছিলেন সবার বড়। 

বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে পার করেছেন নিজের শিক্ষাজীবন। তিনি ১৯৬৭ সালে, যুক্তরাজ্যের “রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস এ”, জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে ‘এফআরসিএস’ ডিগ্রি নিতে ভর্তি হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষার ঠিক আগে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধের ডাক। দেশের জন্য অন্তঃপ্রাণ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি।লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডা. এম এ মোবিনের সাথে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন পাকিস্তানি পাসপোর্ট। সেখান থেকে ‘রাষ্ট্রহীন নাগরিক’ এর প্রত্যয়নপত্র নিয়ে, রওনা হন ভারতের উদ্দেশ্যে। সারাদেশের মানুষের কাছে, তরুণ এই ডাক্তার তখন হয়ে উঠেন, দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। 

অর্থ-সম্পদ গড়ার সুযোগ থাকলেও, দেশে-বিদেশে কোথাও তার একটি ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। বোনকে দান করে দিয়েছেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা।কয়েক হাজার কোটি টাকার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রটিও, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নয়। তিনি একবার বলেছিলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সবকিছুর মালিক, বাংলাদেশের জনগণ। একজন রোগী বা অন্য ১০ জন মানুষের, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর যে অধিকার, ডা. জাফরুল্লাহর অধিকারও, তারচেয়ে বেশি ছিল না। 

ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতি করলেও, পরবর্তী জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেননি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তবে সবসময়ই স্বাধীন রাজনৈতিক মতামতের মাধ্যমে, জনমনে প্রভাব ফেলেছিলেন।

স্বাস্থ্যনীতি, ওষুধনীতি ও নারী শিক্ষা— এমনকি সহজে দেশের মানুষের জন্য, পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে, সরকারকে রাজি করানো এবং প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে, সরকারকে প্রভাবিত করতে তার ভূমিকা, আলোচনায় এসেছে সবসময়।

আক্ষরিক অর্থে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন বিরল ধরণের নির্মোহ মানুষ। এক অর্থে অদ্ভূত মানুষ। পরতেন ঢিলেঢালা শার্ট-প্যান্ট। পুরোনা বাসায় ব্যবহার করেছেন পুরনো আসবাবপত্র। 

গাড়িটাও পুরনো। সব মিলিয়ে নির্মোহ একজন মানুষ। পাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। নিজের জন্য কিছু চাননি। দেশ ও জাতির জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে গেছেন।গত ১১ এপ্রিল, রাত সোয়া ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে, এই মহান মানুষটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

তিনি দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভোগার সাথে সাথে, কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগেও ভুগছিলেন। ড.জাফরুল্লাহর উন্নত চিকিৎসার জন্য, অনেকে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বরাবরই তাতে অসম্মত হয়েছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনি দেশের মানুষের জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি কেন বিদেশে চিকিৎসা নেবেন। ইচ্ছা অনুযায়ী, এই দেশেই চিকিৎসা নিয়ে প্রাণত্যাগ করেন।

সমাজসেবার স্বীকৃতি হিসাবে জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন এই গুণী ব্যক্তি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখায়, ১৯৭৭ সালে লাভ করেন স্বাধীনতা পুরস্কার ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইন সরকারের র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেনের বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত “রাইট লাভলিহুড পুরস্কার, ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ পুরস্কার ।এবং ২০২১ সালে , মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।