অন্যান্য

মাতৃত্বের প্রতি দায়িত্বশীল প্রাণী বনরুই

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২৩
মাতৃত্বের প্রতি দায়িত্বশীল প্রাণী বনরুই

মাছের আঁশের মত দেহবিশিষ্ট এক অদ্ভুত স্তন্যপায়ী প্রাণী বনরুই। চারপেয়ে এই প্রাণীটির মাথা শুঁড়ের মত সরু। 


সারা দেহ রুই মাছের মত মোটা মোটা আঁশ দ্বারা আবৃত। দেহের পেছনে একটি প্রশস্ত লেজ রয়েছে। লেজটিও কাঁটার মত আঁশ দিয়ে গঠিত।


তবে দৈহিক গঠন খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই আঁশগুলো ১৭ থকে ১৮ টি সারিতে সাজানো থাকে। প্রতিটি আঁশের নিচে ৩ থেকে ৪ টি লোম থাকে।  


গলায়, পেটের নিচে এবং মুখের সামনে কিছু অংশ ছাড়া দেহের আর সব স্থানই এমন অদ্ভুত আঁশের চামড়ায় ঢাকা থাকে।  


কালচে ছাই বর্ণের বনরুইদের চোখ খুবই ক্ষুদ্র আর মুখে কোন দাঁত নেই। সে জন্য এদের খাদ্যাভ্যাসও বেশ বৈচিত্র্যময়।     


বনরুইদের জিহ্বা ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এই জিহ্বা দিয়েই তারা খাদ্যগ্রহণের কাজটি করে থাকে। পিঁপড়া ও উইপোকা তাদের প্রধান খাদ্য।


বনরুইদের জিহ্বা আঠালো হয়ে থাকে। তাই জিহ্বা দিয়ে চেটে সহজে যেকোন কীটপতঙ্গ মুখে ঢুকিয়ে নিতে পারে।


জিহবার সাথে সাথে খাবারের জন্য এরা নখও ব্যবহার করে। সামনের পায়ের শেষপ্রান্ত লম্বা ও বাঁকানো নখ বিশিষ্ট হয়ে থাকে।  


নখের সাহয্যে পিঁপড়া আর উইপোকাদের ঢিবি ভেঙে ফেলে, কখনো কখনো মাটি খুঁড়েও পোকামাকড় খুঁজে বের করে। তারপর চেটে চেটে খেয়ে ফেলে।


খাদ্যগ্রহণের পাশাপাশি এই ধারালো নখ আত্মরক্ষার জন্যও ব্যবহার করে। কেউ আক্রমণ করতে এলে নখ প্রসারিত করে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।


অনেক সময় এরা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তাদের দেহের সমান টানেল তৈরি করে। বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে সেখানে শুয়ে থেকে আত্মগোপন করে। 


আত্মরক্ষার জন্য আরও একটি মজার কাজ করে থাকে বনরুই।  


মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর উপস্থিতি টের পেলেই নিজের দেহকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বলের মত গোল করে মাটিতে পড়ে থাকে। যাতে তাদেরকে মৃত মনে করে আর কেউ কাছে না আসে।   


বনরুই খুব একটা সামাজিক প্রাণী নয়, একা একা চলাফেরা করতেই পছন্দ করে। কেবলমাত্র প্রজনন ঋতুতে একসাথে থাকে।


সঙ্গী নির্বাচনের জন্য স্ত্রী বনরুই পুরুষ বনরুইয়ের সন্ধান করে। এক্ষেত্রে পুরুষটি নিজের বর্জ্য ত্যাগের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল চিহ্নিত করে রাখে।


স্ত্রীটি তখন সেই গন্ধ শুঁকে পুরুষটিকে খুঁজে পায় এবং জোড় বাঁধে। প্রজননের জন্য নির্ধারিত অঞ্চলটিকে বলা হয় breeding territory।


জোড় বাঁধার পর বেশ সুন্দর দাম্পত্য জীবন কাটায় বনরুই। মাটিতে একটি গর্ত করে স্ত্রী ও পুরুষ বনরুই একসাথেই বসবাস করে, যতদিন পর্যন্ত বাচ্চা না হয়।   


মাতৃত্বের ব্যাপারে এরা খুবই দায়িত্বশীল। একবারে ১ থেকে সর্বোচ্চ ৩ টি বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাদের জন্ম হয় মাটির গর্তের মধ্যেই।  


তারপর ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্তেই অবস্থান করে। এরপর মা বনরুই বাচ্চাদের নিজের পিঠে লেজের উপর নিয়ে নেয়। 


বাচ্চারা পরিণত না হওয়া পর্যন্ত সেভাবেই বহন করে বেড়ায়। বনরুইয়ের বাচ্চারা প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। 


তারপর পিঁপড়া আর উইপোকা খাওয়া শিখে যায়। মা বনরুই তখন পিঁপড়া বা উইপোকার ঢিবি আক্রমণ করে তাদের শিকার করে এবং বাচ্চারাদের নিয়ে একসাথে খায়।      


এদের লেজ অনেক প্রশস্ত হওয়ায় বাচ্চা দিব্যি লেজের উপর চড়ে বসে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। টানা ২ বছর পর্যন্ত বাচ্চারা মায়ের সাথেই থাকে।


পিপীলিকাভুক বনরুই যেমন মাটিতে চরে বেড়ায়, তেমনি কিছু প্রজাতি আবার গাছেও চড়ে। 


কেউ কেউ মাটিতে গর্ত করে বসবাস করে, কেউ আবার গাছের কোটরে বসতি স্থাপন করে।


বনরুই দেখতে অদ্ভুত হলেও, একটি নিরীহ এবং উপকারি প্রাণী। ফসলের ক্ষেতের পোকামাকড় খেয়ে এরা পরোক্ষভাবে কৃষকের উপকার করে থাকে।


আফ্রিকা ও এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে এই প্রাণীদের দেখা মেলে। বাংলাদেশের পার্বত্য বনাঞ্চলে এদের এখনও পাওয়া যায়।


তবে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বনরুইদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণ অবৈধ শিকার ও পাচার।  


কিছু মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস আর কুসংস্কারের শিকার হচ্ছে নিরীহ প্রাণীটি। 


চীন ও ভিয়েতনামসহ কিছু দেশের মানুষ মনে করে বনরুইয়ের মাংস খেলে যৌবনশক্তি বৃদ্ধি পাবে, যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।


এমন অন্ধ বিশ্বাসের কারণে এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও অমানবিকভাবে শিকার করা হচ্ছে প্রাণীটিকে। বিশেষ করে চীনে এদের মাংস খুবই জনপ্রিয়।  


এমনকি চাইনিজরা এদের নখ ও হাড় দিয়ে ওষুধ বানানোর চেষ্টাও করে থাকে। আবার কোন কোন অঞ্চলে এদের আঁশ দিয়ে অলংকার তৈরি করা হয়।


এসব কারণেই বনরুই এখন বিশ্বের সর্বাধিক পাচারকৃত স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে বিবেচিত।  


এভাবে চলতে থাকলে মহাবিপন্ন প্রাণীটি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।