বরফের দেশ কথাটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে সাদা তুষারে আচ্ছন্ন আঙিনা, তুষারের স্তূপে ঢেকে যাওয়া রাস্তাঘাট আর কনকনে শীতে জমে যাওয়া মানুষজন।
কিন্তু যেভাবে বৈরি আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে সেসব দেশের মানুষ, তা আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষের কাছে সত্যিই বিস্ময়কর।
যেখানে বাংলাদেশে শীতকালীন তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হলেই শীতে কাঁপতে শুরু করে, সেখানে রাশিয়া, গ্রিনল্যান্ড, কানাডা প্রভৃতি স্থানে তাপমাত্রা মাইনাস ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নিচে নেমে যায়।
মেরু অঞ্চলের দেশগুলোতে তাই জীবনধারণ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
এখানে দেহের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে চাইলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় থার্মোমিটার জমে যায়। অনেক স্থানেই থাকে না যাতায়াতের সুব্যবস্থা কিংবা বিদ্যুৎ সংযোগ।
বরফে রাস্তা জমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে চলাচল করাও সম্ভব নয়। কেউ মৃত্যুবরণ করলে তাকে মাটি খুঁড়ে সমাহিত করা সম্ভব হয় না।
কফিন মাটিতে ঢুকানোর জন্য শক্তিশালী করাত দিয়ে বরফের আস্তরণ কাটতে হয়, যাতে সময় লেগে যায় প্রায় ৩ দিন!
রাশিয়ার অইমিয়াকন গ্রামের তাপমাত্রা এতটাই কম যে, এক গ্লাস গরম জল শূন্যে ছুঁড়ে দিলে তা নিচে নামতে নামতে জমে বরফ হয়ে যায়।
ডিপফ্রিজের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে রাশিয়ার এই গ্রামের তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রিরও নিচে নেমে যায়।
শ্বাস প্রশ্বাস নেয়াও দুরূহ এখানে, চশমার কাচ ঘোলা হয়ে যায়, জমে যায় চোখের পাতা আর ভ্রূ।
বছরের ৭ মাসই স্থানটি ঢাকা থাকে পুরু বরফের আস্তরণে।
কলার মত নরম ফল এসব দেশে জমে হাতুড়ির মত শক্ত হয়ে যায়, তখন কলা দিয়ে পিটিয়ে কাঠে পেরেক ঢুকানো যায়।
ভেজা কাপড় শুকাতে দিলে জমে কাগজের মত খড়খড়ে হয়ে যায়। এমনকি কলম দিয়ে লেখা যায় না পর্যন্ত, কারণ কলমের কালিও জমে থাকে।
তার চেয়েও বড় সমস্যা হল, গ্লাসের পানি পান করতে চাইলেও সাথে সাথে জমাট বেঁধে বরফে রূপ নেয়।
এসব স্থানের প্রতিটি বাড়িতেই থাকে ফায়ারপ্লেস। ঘর গরম রাখতে দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই জ্বালিয়ে রাখতে হয় আগুন।
সুপেয় পানিও জমে যাওয়ায় অধিবাসীরা বরফের টুকরো ফায়ারপ্লেসের আগুনে গলিয়ে- পানিতে পরিণত করে তারপর পান করে।
প্রতিকূল এই স্থানের মানুষের প্রধান জীবিকা মৎস্য শিকার আর বল্গা হরিণ পালন। তবে মাছ ধরার জন্যও বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
বরফে জমে থাকা নদীতে ঈগল পাখি মাছের সন্ধানে বরফ খুঁড়ে রেখে যায়, সেই জায়গাগুলো খুঁজে খুঁজে অধিবাসীরা বর্শা দিয়ে নদীর জমে থাকা পানি ভেঙে মাছ তুলে আনে।
আলাস্কা, কানাডা, সাইবেরিয়া আর গ্রিনল্যান্ডের বরফের রাজ্যে বসবাস করে ইনুইট এস্কিমো সম্প্রদায়ের মানুষ।
চ্যাপ্টা নাক আর সরু চোখবিশিষ্ট ছোটখাটো এস্কিমোরা শীতের হাত থেকে বাঁচতে- লোমযুক্ত সীল মাছের চামড়ার তৈরি পোশাক পরে থাকে।
মাথাও ঢেকে রাখে লোমের টুপিতে, হাত ঢাকা থাকে চামড়ার মোজায়, আর পায়ে পরে থাকে হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত জুতো।
এস্কিমোরা স্নান করে না, কারণ কখনোই গা থেকে কাপড় খোলা সম্ভব হয় না, তাছাড়া তরল পানিও সহজলভ্য নয়।
ফসল বা সবজি জন্মানোর উপায় নেই বলে এদের প্রধান খাবার পশুর মাংস আর মাছ। কুকুর এস্কিমোদের প্রধান বাহন।
কুকুর টানা স্লেজ গাড়িতে চড়েই তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে। আর মাছ শিকারের সময় ব্যবহার করে 'কাইআক' নামের অদ্ভুত ধরণের নৌকা।
বিশেষ কৌশলে তারা সিল মাছ শিকার করে থাকে। গ্রীষ্মের সময় যখন কয়েকমাসের জন্য সূর্যের দেখা পাওয়া যায়, তখন সিল মাছ সমুদ্রের ধারে রোদ পোহাতে আসে।
আর সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এস্কিমোরা। সাথে সাথে বর্শা দিয়ে আঘাত করে শিকারকে ধরে ফেলে তারা।
গ্রীষ্মকালে শিকার করা মাছ ও মাংস এস্কিমোরা শীত মৌসুমের জন্য শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখে।
বসবাসের জন্য এস্কিমোদের ঘরবাড়ি একেবারেই আলাদা হয়। ইট বা কাঠের তৈরি বাড়িতে থাকা হয় না তাদের।
কারণ মেরুতে অতিরিক্ত ঠাণ্ডার জন্য বড় বড় গাছ জন্মায় না। তাই জ্বালানী কিংবা কাঠের তীব্র অভাব।
বাড়ি বানানোর জন্য এস্কিমোরা বরফই ব্যবহার করে। তাদের বসতি গড়ে ওঠে বরফের তৈরি ইগলুতে।
পাঁচ থেকে ছয় ফুট উচ্চতাসম্পন্ন এই ইগলুতে ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। ঘরের ভেতরে সারাক্ষণই জ্বালিয়ে রাখে পাথরের প্রদীপ।
সমুদ্রের শ্যাওলা দিয়ে তৈরি করা হয় প্রদীপের সলতে, আর প্রদীপ জ্বালাতে ব্যবহার করা হয় সীল মাছের চর্বি থেকে উৎপন্ন তেল।
৬ মাস আঁধার ঘেরা রাতের হিমায়িত জীবনে এস্কিমোরা অপেক্ষায় থাকে কখন আসবে গ্রীষ্মকাল, দেখা মিলবে একটু খানি সূর্যালোকের। বরফের দেশে জীবনযাপনের অপর নাম তাই সংগ্রাম!