রাজধানীর করাইল বস্তির ক ব্লকে স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট সংসার ছিল শাকিল হাসানের। বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর পরিবারের সঙ্গে সামান্য সময় কাটানো—এসবই ছিল তার সংসারের স্বল্প সুখ। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার রাতে লেলিহান আগুনের শিখা কয়েক মুহূর্তেই সেই শান্তি, স্বপ্ন ও সঞ্চয় সবকিছু পুড়িয়ে দেয়।
আগুনে ঘর, আসবাব, পোশাক, সঞ্চিত টাকা—সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবে সবকিছুর মাঝেও রক্ষা পায় একটি টিনের ট্রাঙ্ক। এই ট্রাঙ্কেই ছিল শাকিলের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ব্যাংকের কাগজপত্র, শিক্ষাগত সনদ এবং ভবিষ্যতের লড়াইয়ের মূল রসদ।
আজ বুধবার বেলা ১১টার দিকে পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়ানো শাকিল ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় নথিগুলো বের করছিলেন। চোখে তখনও আতঙ্ক আর বেঁচে যাওয়ার স্বস্তি।
শাকিল জানান, আগুন লাগার সময় তিনি অফিসে ছিলেন। খবর পেয়ে দৌড়ে এসে দেখেন আগুন তার ঘরের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। তার স্ত্রী ও মেয়ে ঘরে তালা দিয়ে আগেই নিরাপদ দূরত্বে চলে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, পরিবার নিরাপদ আছে—এটা জানার পর সাহস পেলাম। দ্রুত তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকতেই চোখে পড়ে কোণের সেই ১০ বাই ১৮ ইঞ্চির ট্রাঙ্কটা। জানতাম, এর ভেতরেই আমার সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আছে।
ঘরের ওয়ার্ডরোবের সামান্য টাকা বের করার সময়ও ছিল না। আগুন তখন একেবারে ঘরের মাথায়। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে ট্রাঙ্কটা তুলে নিচে নেমে পানির হাউসে ফেলে দিলাম। এরপর যখন আবার ওপরে তাকালাম, দেখলাম ঘরের চালেও আগুন ধরে গেছে। আর সময় পাইনি। জীবন বাঁচাতেই ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে হয়,” যোগ করেন তিনি।
আগুন থেকে বাঁচতে শাকিল বস্তির সামনের পথ দিয়ে যেতে পারেননি। গুলশান লেক–সংলগ্ন পেছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যান। ভোরে ফিরে দেখেন, তার ঘরের আর কোনো চিহ্নই নেই—সব পুড়ে গেছে।
আগুনের পর শাকিল, তার স্ত্রী ও ছোট মেয়ে খোলা আকাশের নিচে এরশাদ মাঠে রাত কাটান। পরবর্তীতে কোথায় থাকবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখনো জানি না। মাথা গোঁজার মতো জায়গা নেই।
করাইল বস্তিতে আগুন লাগা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় সবারই নিজস্ব কৌশল আছে। কেউ ট্রাঙ্কে, কেউ বালতি বা পাতিলে, কেউ আবার পলিথিনে বেঁধে পানি-ভর্তি হাউসে রেখে দেন তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস—পরিচয়পত্র, সার্টিফিকেট, পাসবুক, জমা টাকা।
আগুন নিভে গেলে সেই জিনিসগুলো পানি থেকে তুলে নেন। অন্তত জরুরি কিছু নথি বেঁচে গেলে আবার দাঁড়ানোর পথ থাকে।
শাকিল বলেন, আগুন আমার সব নিয়ে গেছে… আমার জমানো টাকা, ঘর, জামাকাপড়—কিছুই নেই। কিন্তু এই ভিজে যাওয়া ট্রাঙ্কটা আমার ভবিষ্যতের ভরসা। এই কাগজপত্র ছাড়া তো আমি কোথাও দাঁড়াতে পারতাম না।
সব হারিয়ে ভেঙে পড়লেও ওই ছোট্ট ট্রাঙ্ক তাকে এখনো লড়াই করার শক্তি দিচ্ছে।