খেলা

অস্ট্রেলিয়ার হেক্সা বিশ্বকাপ, স্তব্ধ গোটা ভারত

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৩
অস্ট্রেলিয়ার হেক্সা বিশ্বকাপ, স্তব্ধ গোটা ভারত
মহারণের আগ পর্যন্ত ছিল অপ্রতিরোধ্য। কোহলি, রোহিত শর্মা, শুভমন গিল, কে এল রাহুলের ব্যাটও হাসছে প্রতিনিয়ত। আর বল হাতে দারুণ ফর্মে থাকা শামি-বুমরাহ। তাতে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের সব প্রস্তুতিই নেয় ভারতীয়রা। কিন্তু তীরে এসে ডুবলো তরী। স্তব্ধ হলো গোটা ভারত। রোহিত শর্মার দলকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ৬ষ্ঠবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা উচিয়ে ধরলো অজিরা।

ভারতীয়দের এই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে নিশ্চিত। ভারতীয় ক্রিকেটে ক্ষণ ক্ষণ মনে পড়বে এই দুঃখ! নিজেদের মাঠিতেই ফসকে গেলো বিশ্বকাপ স্বপ্ন। অথচ বিশ্বকাপে বাকি সব ম্যাচে প্রতিপক্ষকে কতই না দুমড়ে মুচড়ে ফাইনালে উঠে আসে টিম ইন্ডিয়া। আর সেই ইন্ডিয়াকেই দুমড়ে মুচড়ে দিলে স্তব্ধ হয়ে পড়ে আহমেদাবাদের নরেন্দ মোদি স্টেডিয়ামের ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের করতালি।

হৃদয় ভাঙলো ভারতীয় দর্শকদের


রোববার (১৯ নভেম্বর) ফাইনালের এই মহারণে টস জিতে ভারতকে ব্যাটিংকে পাঠায় অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। ব্যাটিংয়ে নেমে স্কোর বোর্ডে ঝড়ো গতিতে রান তোলার তাড়া ছিল ভারতের। কিন্তুই তাই কাল হলো। উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে। ম্যাচের পঞ্চম ওভারে স্টার্কের শর্ট লেন্থের বলে চড়াও হন গিল, কিন্তু যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে খেলতে পারেননি, লেংথও ঠিক সে শট খেলার পক্ষে ছিল না। গিলের পুলে সরাসরি ক্যাচ যায় মিড অনে থাকা অ্যাডাম জাম্পার হাতে। ৭ বলে ৪ রান করে ফেরেন গিল।

এরপর তিনে নামা বিরাট কোহলিকে সঙ্গী করে ঝড়ো গতিতে রান তুলতে থাকেন রোহিত। সপ্তম ওভারেই পূর্ণ করেন দলীয় অর্ধশতক। একের পর এক বল বাউন্ডারিতে আছড়ে ফেলতে শুরু করেন রোহিত শর্মা। তবে পাওয়ার প্লে'র শেষ ওভারে বল হাতে এসেই রোহিত ঝড় থামান গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।

রোহিত শর্মা ৩১ বলে ৪৭ রান করে যখন ফিরলেন তখন ভারতের স্কোরবোর্ডে রান ৭৬। চারে ব্যাট হাতে আসেন শ্রেয়াস আইয়ার। এসেই বাউন্ডারি দিয়ে শুরু। তবে ১১তম ওভারে প্যাট কামিন্স সিম ঘুরিয়ে দেওয়া বলটি ধরে রেখেছিল লাইন। শ্রেয়াস আইয়ার খোঁচা দিয়েছেন তাতে। পরপর ২ ওভারে ২ উইকেট হারিয়েছে ভারত। আইয়ার ফিরলেন ৩ বলে ৪ রান করে। ভারত ৮১ রানে হারালো তৃতীয় উইকেট।

এরপর ভারতীয় ব্যাটিং স্তম্ভ বিরাট কোহলি তখন একাই লড়াই চালিয়ে যান। দলকে বিপদ থেকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে এই জুটি। অজি বোলারদের অনেকটাই দেখে শুনে খেলেছেন দুজনই। যেখানে শুরুর দিকে বাউন্ডারির ফুলঝুড়ি ফুটেছিল, সেখানে বিপদ এড়াতে এই জুটি সিঙ্গেল-ডাবলের ওপরেই ভরসা রেখেছেন। ১০ থেকে ২০ ওভারের মাঝে একটিও চার ছয় হাঁকাতে পারেনি ভারত!

কোহলি ও লোকেশ রাহুল মিলে ইনিংস মেরামতের কাজে মন দেন। অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে জুটির পঞ্চাশ করতে লেগেছে ৮৮ বল। কোনো বাউন্ডারি হয়নি এই জুটিতে। চলতি বিশ্বকাপে নবম পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংসে ৫৬ বলে মাইলফলক স্পর্শ করেছেন কোহলি। তিনি মেরেছেন চারটি বাউন্ডারি। সবগুলোই প্রথম দশ ওভারের ভেতরে। ধীরগতির ব্যাটিংয়ে আরেকটি হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন বিরাট কোহলি। ইনিংসের ২৬তম ওভারের প্রথম বলেই সিঙ্গেল নিয়ে তুলে নিলে অর্ধশতক। তাকে দারুণভাবে সঙ্গ দিয়েছেন রাহুল, তিনিও ধীরে সুস্থেই ব্যাটিং করেছেন পুরোটা সময়।

কিন্তু কামিন্সের শর্ট লেংথের বল আলতো করে খেলতে চেয়েছিলেন কোহলি। তবে বল এতটা উঠবে, ভাবতে পারেননি। ব্যাটের কানায় লেগে বল গিয়ে ভেঙেছে স্টাম্প। ফাইনালের মহাগুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক। কোহলি থেমেছেন ৬৩ বলে ৫৪ রান করে। রাহুলের সঙ্গে তার জুটি ভেঙেছে ৬৭ রানে।

হারের পর মুখ লুকাচ্ছেন ভিরাট কোহলি


কোহলি ফেরার পর উইকেটে আসেন জাদেজা। এসে রাহুলের সঙ্গে ধীরেসুস্থে এগোতে থাকেন রানের গতি। এর মধ্যেই ৮৬ বলে ৫০ রাহুলের। রাহুলের ফিফটির পর বেশি সময় টিকতে পারেননি জাদেজা। ৩৬তম ওভারের চতুর্থ বলেই জাদেজার বিপক্ষে কট বিহাইন্ডের রিভিউ নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। যদিও তাদেরকেই ঠিক আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি। তবে পরের বলে আর রিভিউ দরকার পড়েনি। হ্যাজলউডের অফ স্টাম্পের বাইরের লাইন ধরে রাখা বলে খোঁচা দিয়ে ফিরে গেছেন জাদেজা। ২২ বল খেলে এ বাঁহাতি করতে পেরেছেন ৯ রান। ভারত ১৭৮ রানে হারায় পঞ্চম উইকেট।

সাতে ব্যাট হাতে আসেন সূর্যকুমার যাদব। তাকে নিয়ে ইনিংস শেষের দিকে এগোতে থাকেন রাহুল। তবে লোকেশ রাহুলের জন্য মিচেল স্টার্কের এ ডেলিভারি যথেষ্টর চেয়েও বেশি কিছু হয়ে গেল। কোহলির পর রাহুলও থামলেন ৫০ পেরিয়েই। শুরু থেকে সতর্ক খেলছিলেন, ৪০ ওভার পেরিয়ে যাওয়ার পর এসে রাহুল আউট হলেন রক্ষণাত্মক শট খেলতে গিয়েই। ১০৭ বলে মাত্র একটি চারে ৬৬ রান করে রাহুল ফিরলেন দলীয় ২০৩ রানে।

শেষ দিকে সূর্যকুমার যাদব ১৮ রান আর কুলদিপ ১০ আর সিরাজ ৯ রান করলে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ভারত ২৪০ রানে অল আউট হয়।

অস্টেলিয়ার হয়ে তিন উইকেট নেন মিচেল স্টার্ক। দুটি করে উইকেট নেন জশ হ্যাজেলউড এবং প্যাট কামিন্স। এছাড়া একটি করে উইকেট নেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও অ্যাডাম জাম্পা।

রান তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়াও শুরু থেকেই দ্রুত রান তুলতে চেয়েছে। পরের ওভারগুলোতে উইকেটে স্পিন ধরবে ভেবেই হয়তো অজিদের এমন কৌশল। জাসপ্রিত বুমরাহর করা প্রথম ওভার থেকেই ১৫ রান তুলে সেই কৌশলের যথার্থতার প্রমাণ দিচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। তবে দ্বিতীয় ওভারেই অজিদের টেনে ধরেন মোহাম্মদ শামি।

টুর্নামেন্ট জুড়েই দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মোহাম্মদ শামি দারুণ এক সুইং বলে ডেভিড ওয়ার্নারকে স্লিপে ক্যাচ বানান। শুরুতে ওয়ার্নার ফিরলেও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং বন্ধ করেনি অস্ট্রেলিয়া। ট্রাভিস হেড ও মিচেল মার্শ বেশ ভালোই খেলছিলেন। এরপর জাসপ্রিত বুমরাহর জোড়া আঘাত।

১৫ রান করা মার্শকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ বানান বুমরাহ। খানিক বাদে বুমরাহর দারুণ এক স্লো বলে পরাস্ত হয়েছেন স্টিভ স্মিথ। ভারতীয় ফিল্ডারদের জোড়ালো আবেদনের মুখে আউট দিয়ে দেন আম্পায়ার। স্মিথ আর রিভিউও নেননি। কিন্তু পরে দেখা যায় ইমপ্যাক্ট ছিল বাইরে, অর্থাৎ রিভিউ নিলে আউট হতেন না স্মিথ! বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো ম্যাচে ম্যাচে এমন ভুল নিশ্চয় যন্ত্রণা দিবে স্মিথকে!

৪৭ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে অজিরা। আর ভারতও ম্যাচে ফেরে। কিন্তু ক্রিজে থাকা ট্রাভিড হেড ও মার্নাস লাবুশেন দলকে টেনে নিলে ভারতের হৃদয় ভাঙে।

এই জুটিতে আসে ১৯২ রান। ১২০ বলে ১৩৭ রানের অবিস্মরণীয় এক ইনিংস খেলেছেন হেড। তাকে মার্নাশ লাবুশেন সঙ্গ দিয়েছেন দুর্দান্তভাবে। অজিদের বিশ্বকাপ জিততে যখন মাত্র ২ রান প্রয়োজন তখন ফিরেন হেড। তার ইনিংসে চারের মার ছিল ১৫টি, ছক্কা ৪টি।

৬ষ্ঠবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া


এরপর ৬ উইকেটের পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে রোহিত শর্মার দল। আর বিশ্বকাপে অষ্টম ফাইনাল খেলতে নেমে ষষ্ঠ শিরোপা জিতলো অস্ট্রেলিয়া। অপর দিকে, এর আগে দুইবার শিরোপা জেতা ভারত চতুর্থবার ফাইনাল খেলতে নেমেছিল।