বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অপসারণের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। মঙ্গলবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচিতে রিজভী বলেন, “বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামানো উচিত হয়নি।” তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, খন্দকার মোশতাকও একসময় বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তা পুনঃস্থাপন করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার, এবং অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে সরকার পতনের তিন মাস পরও বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরানো হয়নি, যা নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে সমালোচনা চলছিল। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানোর উদ্যোগ নেন, যা এই বিষয়টিকে আরও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
শপথগ্রহণের পরদিনই মাহফুজ আলম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বঙ্গভবন থেকে সরিয়ে ফেলেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই পদক্ষেপের জন্য ব্যাখ্যাও দেন। তিনি তার পোস্টে উল্লেখ করেন, “দরবার হল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পোস্ট-‘৭১ ফ্যাসিস্টের ছবি সরানো হয়েছে।” মাহফুজ তার এই পোস্টে আরও লিখেন যে, “জুলাইয়ের চেতনা মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য আমরা এই ছবি সরিয়েছি। আমাদের জন্য এটি লজ্জাজনক যে আমরা এতদিন তা সরাতে পারিনি, এবং এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।”
মাহফুজ আলম আরও বলেন যে, বঙ্গবন্ধুর ছবি সরানোর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জনগণের পক্ষ থেকে ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের বিরুদ্ধে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিব এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার আমলে ভিন্নমতাবলম্বী এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নিপীড়ন, অগণতান্ত্রিক শাসন, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার চাইছে। তার ভাষ্যমতে, “শেখ মুজিব এবং তার কন্যা বাংলাদেশে যা করেছেন, তা আওয়ামী লীগকে স্বীকার করতে হবে এবং ক্ষমা চাইতে হবে।”
এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানের পরিবর্তন, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি এবং বিরোধীদের উপর চালানো সহিংসতার বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যে ফুটে ওঠে যে, ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের শিকার হওয়া মানুষদের ন্যায়বিচার এবং এই অপরাধের ক্ষমা ছাড়া আওয়ামী লীগের সাথে কোনো সংলাপ সম্ভব নয়।
রুহুল কবির রিজভী এই প্রসঙ্গে বলেন, “বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো উচিত হয়নি, কারণ এটি ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশের জাতির পিতার স্মৃতির সাথে সংযুক্ত।” তার মতে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অযৌক্তিক এবং তা আরও বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। তিনি মনে করেন, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির জন্য শাসক দল ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সম্মান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
রিজভীর মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের উচিত রাজনৈতিক সম্প্রীতি রক্ষা করা এবং দেশের জনগণের মনোভাবকে সম্মান জানানো। জাতির পিতার ছবি বঙ্গভবনে থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি, কারণ এটি একটি সম্মানজনক বিষয় এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতীক।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই মনে করছেন, একটি নতুন সরকারের জন্য পুরোনো সরকার বা তাদের নায়কদের ছবি অপসারণ করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়, কারণ এটি জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অন্যদিকে, কিছু মানুষ মনে করছেন যে, বঙ্গবন্ধু এবং তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে চলমান বিতর্কে এই পদক্ষেপ স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসকে নতুনভাবে পর্যালোচনা করার একটি সুযোগ তৈরি করেছে।
এদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি দেশের রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করতে পারে এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও অনুরূপ বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। রাজনীতিবিদদের উচিত এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলিকে অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সাথে মোকাবিলা করা, যাতে দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে এবং জাতির পিতার প্রতি সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে।