জনতা ব্যাংক, যা একসময় সরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল, বর্তমানে চরম দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপির মুখোমুখি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন জালিয়াত ও লুটপাটকারী চক্র ব্যাংকটির প্রতি নজর দেয়। এ সময় থেকে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতিগ্রস্ত পর্ষদ এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কারণে ব্যাংকটি দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ৪৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৪৮ শতাংশ।
জনতা ব্যাংকের অবস্থান ২০০৮ সাল পর্যন্ত বেশ শক্তিশালী ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম শুরু হয়। ২০১০ সালের পর থেকে ঋণ বিতরণের স্থিতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। প্রথমে বিসমিল্লাহ গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে, যা সুদসহ ১,১০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পরবর্তী সময়ে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেয়। এটি ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন হলেও রাজনৈতিক প্রভাবে এই ঋণ প্রদান করা হয়। বর্তমানে এই ঋণের অধিকাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।
এছাড়া অ্যানন টেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের মাধ্যমে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যা সুদসহ এখন ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি হয়ে গেছে। এছাড়া এস আলম গ্রুপ ও রানাকা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানও ঋণের বিশাল অংশ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশ সত্ত্বেও জনতা ব্যাংক সংশ্লিষ্ট জালিয়াতদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং নিয়ম ভাঙার সংস্কৃতির কারণে ব্যাংকটি একসময় শক্তিশালী অবস্থান থেকে এখন দুর্বল অবস্থায় চলে এসেছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা, যার অর্ধেকেরও বেশি খেলাপি ঋণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণ বিতরণের হার দ্রুত বেড়ে গেলেও তা আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। ২০১০ সালে যেখানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১,১৮২ কোটি টাকা, তা ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বেড়ে ৪৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৮৫ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা, যা ৭ গুণ বৃদ্ধি। অন্যদিকে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা, যা ২৭ গুণ বেশি।
জনতা ব্যাংকের এই অবস্থা দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে একটি বিরল ঘটনা এবং এটি ব্যাংকটির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।