পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ছোঁয়ায় বছর কয়েকের ব্যবধানে বদলে গেছে রূপপুর এলাকার চিত্র।কিছুদিন আগেও রূপপুর সীমাবদ্ধ ছিল ফাঁকা মাঠ আর কাঁটাতারের বেড়ায় আটকানো দু-একটি অস্থায়ী স্থাপনায়। এলাকায় দু'একটা উঁচু ভবন খুঁজে পেতে কষ্ট হতো। চারদিকে কেবল ধু ধু বালুচর, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি আর ছোট ছোট কিছু দোকানপাট দেখা যেতো। সব মিলিয়ে প্রত্যন্ত গ্রাম হিসেবেই গণ্য করা হতো একে।
কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে গ্রামের চেহারা। প্রকল্পের কাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে একের পর এক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। এটি এখন হাসপাতাল, বিপণি বিতান, বিদ্যালয়, সুউচ্চ ভবন, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল আর রেস্টুরেন্টে মুখরিত। সুউচ্চ সব ভবনের সারিতে রূপপুর যেন আজ এক আধুনিক শহরে পরিণত হয়েছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে দেশি বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজারের মতো প্রকৌশলী-শ্রমিক কাজ করছেন। বিদেশীদের মধ্যে বেশিরভাগই রুশ নাগরিক। যার কারণে এলাকাটিতে পড়েছে রুশ সংস্কৃতির প্রভাব। এখানকার দোকানপাট থেকে শুরু করে সবকিছুতে বাংলা ভাষার পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষার প্রচলন দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ানদের সঙ্গে মালামাল বেচা কেনার সুবিধার্থে ব্যবসায়ীরাও রাশিয়ান ভাষা শিখেছেন। রেস্তোরাঁর নাম রাখা হয়েছে রাশিয়ান ডাইন, মস্কো হোটেল, রুশ ফ্যাশন । এছাড়াও রয়েছে মস্কো টাওয়ার।
সাইনবোর্ডগুলোতে বাংলা-ইংরেজির পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষাও লেখা রয়েছে। এলাকাটিকে হঠাৎ দেখে যে কেউ রাশিয়া ভেবে ভুল করতে পারেন।এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছেন রূপপুরের কয়েক হাজার বেকার যুবক। এতে তাদের ভাগ্য যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে সামাজিক চিত্রও। এছাড়া চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্ট, বিপণি বিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ।
প্রকল্পের কারণে এ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকার রাস্তাঘাট নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য নতুন করে রাস্তা নির্মিত হচ্ছে। প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে। এছাড়া নতুন করে ঈশ্বরদীতে ২৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। উন্নতমানের হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের কর্মকর্তা আর শ্রমিকদের বসবাসের জন্য প্রকল্প এলাকার কাছে গ্রিন সিটি গড়ে তুলেছে সরকার। যেখানে ২০ তলা করে গড়া ২০টি ভবনে থাকছেন কর্মীরা। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণপ্রকল্প হওয়ায় অবহেলিত এ জায়গাটি অনেক মূল্যবান হয়েছে। বদলে দিচ্ছে এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ। অভাব-অনটনের কারণে আগে এসব গ্রামে প্রায়ই নানা ধরনের কলহ নিরসন করতে বিচার-সালিশ করতে হতো। বেকারত্ব দূর হওয়ায় গ্রামে এখন আর সেই পরিবেশ নেই। পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, এই কয়েক বছরে রূপপুরে যতটা উন্নয়ন হয়েছে, বিগত ৫০ বছরেও এমন কাজ হয়নি। প্রসঙ্গত, আর্থিক বিচারে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হলো রূপপুরে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর পাশেই নদীতীরে চলছে দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ।
প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে রাশিয়া। ২৬০ একর জায়গার ওপর চলছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মযজ্ঞ। বেশ জোরেশোরেই চলছে মূল প্রকল্পের কাজ। এখন পর্যন্ত ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট নির্মাণের কাজ এগিয়েছে ৮৭ শতাংশ। তবে মূল কাজের অগ্রগতি বেশি হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পিজিসিবির সঞ্চালন প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশের কিছুটা বেশি। যে কারণে আগামী ডিসেম্বরে মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও তা এখন পিছিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ পেতে এখন আরও দুই বছরের মতো অপেক্ষা করতে হবে।