শহরের কোলাহলে আপনি যখন অনেকটা ক্লান্ত তখন একঘেয়েমি দূর করতে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে। সুন্দরবন (Sundarbans) পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এটি ইউনেস্কোর একটি অন্যতম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। পুরো বনটিতে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, ছোট ছোট নদী, খাল-বিল ও কাদাযুক্ত চর। নিজ চোখে খোলা পরিবেশেই দেখতে পাবেন বাঘ, হরিন, কুমির, বানর, অজগর সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ।
সুন্দরবনের বিশেষ দর্শনীয় স্থান
সুন্দরবনে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। বনবিভাগ থেকে সুন্দরবনে ভ্রমনের জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থান ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়।
হারবাড়িয়া
সুন্দরবনের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র হারবাড়িয়া। মংলা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। এই স্থানের মূল আকর্ষণ বনের ভিতর দিয়ে যাওয়ার কাঠের ট্রেইল। সম্পূর্ণ ট্রেইলটা ঘুরে আসতে ৩০ মিনিট সময় লাগে। এখানে দেখার মতো পদ্মপুকুর ও ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে যেখান থেকে পুরো হাড়বাড়িয়া খুব ভালো ভাবে উপভোগ করা যায়।
করমজল
মংলা থেকে খুবি কাছে অবস্থিত করমজল। এটি মুলত বন বিভাগের হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র। পথেই নজরে আসবে সুন্দরবনের ম্যাপ। এখানে বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া কাঠের পুলের ট্রেইল, হরিণ, কুমির, বানর সহ নানা প্রজাতির গাছ গাছালি রয়েছে।
কটকা অভয়ারণ্য
কটকা ফরেষ্ট ষ্টেশনের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোবসাগর। সাগরের কোল ঘেষেই কটকা আভায়ারন্য। কটকায় সবচেয়ে বেশি বন্য হরিণ দেখা যায়। এখানেও বনের ভিতর একটি কাঠের ট্রেইল রয়েছে। কটকা পয়েন্ট এর ট্রেইল ধরে কিছুদূর হাঁটলেই চলে যাওয়া যাবে কটকা সমুদ্র সৈকতে। কটকা সৈকত অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। এর বেলা ভূমিতে লাল কাঁকড়াও দেখতে পাওয়া যায়।
জামতলা সি বিচ
কটকার কাছেই জামতলা সি বিচ অবস্থিত। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে, যা থেকে সুন্দরবনের সৌন্দর্য্যের কিছু অংশে উপভোগ করা যায়। জামতলা ঘাট থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ দিয়ে গেলে দেখা মিলবে জামতলা সমুদ্র সৈকত।
হীরন পয়েন্ট
হীরন পয়েন্টের কাঠের তৈরি সুন্দর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হরিণ, বানর, গুইসাপ ও কুমির দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। এখানে মাঝে মাঝে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখাও পাওয়া যায়।
দুবলার চর
সুন্দরবন এলাকার মধ্যে ছোট্ট একটি চর এটি। শুটকির উৎপাদনে বিখ্যাত এই দুবলার চর। দুবলার চরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এই পাঁচ মাস প্রায় ১০ হাজার জেলে সাময়িক বসতি গড়ে তোলে সেখানে। মাছ ধরার পাশাপাশি সেখানে চলে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। বিকাল- সন্ধ্যার দিকে এখানে বাজার বসে, সেটি দেখে আসতে পারেন।
সুন্দরবন যাওয়ার উপায়
সুন্দরবনে যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নিরাপদ দুটি পথ হচ্ছে খুলনা অথবা মংলা দিয়ে যাওয়া। খুলনা থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজ মংলা হয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে।
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে করে সরাসরি খুলনা যাওয়া যায়। গুলিস্তান, সায়দাবাদ ও গাবতলি থেকে অনেক বাস খুলনা যাতায়াত করে। আপনি এমন যেকোন বাস যোগে খুলনা যেতে পারবেন এর জন্য নন-এসিতে জনপ্রতি ভাড়া পরবে ৬০০-৭০০ টাকার মতো এবং এসি বাসে জনপ্রতি ভাড়া পরবে ৭০০-১৪০০ টাকা। ঢাকা থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন ও চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেন যাতায়ত করে। ট্রেনের ভাড়া বাসের চেয়ে তুলনামুলক কম। শোভন চেয়ার ও বিজনেস ক্লাসের যেকোন আসন গ্রহনের মাধ্যমে ঢাকা থেকে খুলনা যাতায়াত করা যাবে।
সুন্দরবন ভ্রমনের উপায়
যারা সুন্দরবনের সকল স্পট ঘুরতে চান এবং গহীন বনের নদীতে রাত্রি যাপন করতে চান, তাঁরা ঢাকা থেকে ভালো মানের ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে তাদের প্যাকেজগুলো (ঢাকা টু সুন্দরবন) নিতে পারেন। সুন্দরবনের ভিতরে ভ্রমণ করতে হলে অবশ্যই ফরেস্ট অফিস থেকে নির্ধারিত ফি দিয়ে অনুমতি নিতে হবে এর পাশাপাশি সঙ্গে ট্যুরিস্ট পুলিস নিয়ে ভ্রমন করতে হবে। আর সব গুলো স্থান ঘুরে দেখতে হবে লঞ্চ ও ভ্যাসেলএর মাধ্যমে।
সুন্দরবন ট্যুর প্যাকেজ খরচ
সুন্দরবনে মোটামুটি মানের জাহাজে করে ঘুরতে প্রতি জনসুন্দরবন ট্যুর প্যাকেজএর দামপরবে ৭৫০০-১৬০০০ টাকা। আর বিলাসবহুল টুরিস্ট ভ্যাসেলে ভ্রমণ করতে চাইলে জনপ্রতি ১৫,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হবে। প্যাকেজ গুলো মূলত ২ রাত ৩ দিন অথবা ৩ রাত ৪ দিনের হয়ে থাকে। এডভান্স দিয়ে এক মাস আগে বুকিং না দিলে ভ্যাসেল পাওয়া কঠিন।
একসাথে ৩০-৪০ জনের গ্রুপে যেতে চাইলে নিজেরাই লঞ্চ বা শীপ ভাড়া করতে পারেন। সেক্ষেত্রে খরচ নির্ভর করবে সার্ভিস অনুযায়ী। ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ভ্রমণে গেলে সাধারণত প্যাকেজ গুলোতে সব ধরণের ফি অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাই আলাদা করে ফি দিতে হয়না। এতে করে বিরক্ততা কম আসে কার যেখানে যা কিছুর প্রয়োজন হবে তা পূর্বে থেকে প্রস্তুতি নেয়া থাকে।
যারা স্বল্প খরচে সুন্দরবনে ট্যুর দিতে চান, সেক্ষেত্রে খুলনা থেকে ট্রলার রিজার্ভ নিয়ে ২/৩ টা স্পটে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে বনে রাত্রি যাপনের কোনো সুযোগ নেই।
পরিশেষে বলা যায়,
ভ্রমন পিপাসুদের জন্য ঝুড়ি ঝুড়ি সৌন্দর্য্য সাজিয়ে বসে আছে সুন্দরবন। এখানকার জীব বৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য থেকে মুগ্ধ হয় যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। তাই ছুটির দিনে পরিবারের সাথে রয়েল বেঙ্গল টাইগার সহ বিচিত্র ধরণের পাখি, হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে ঘুরে আসতে পারেন।