বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ধারার বাহক—বাউল, পালাকার ও বয়াতিরা—সাম্প্রতিক সময়ে বারবার আক্রমণ, বাধা ও মামলার মুখে পড়ছেন। সরকার বদলালেও তাঁদের ওপর চাপ কমছে না। বরং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও কয়েক ডজন মাজার ভাঙচুর, মাজারের মৃত পীরকে কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনার অভিযোগ উঠেছে।
গত এক–দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগীতানুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া, শিল্পীদের ওপর হামলা এবং মামলার ঘটনাও বেড়েছে। সর্বশেষ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মানিকগঞ্জের বিখ্যাত পালাকথক আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের ঘটনা। কয়েক দিন আগে সংগীত পরিবেশনের সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও কটূক্তির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
২৩ নভেম্বর লেখাটি লেখা পর্যন্ত খবর আসে—কথিত ‘তৌহিদি জনতা’র হামলায় আবুল সরকারের সমর্থকেরা আহত হয়েছেন; অনেকে হামলা থেকে বাঁচতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছেন। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নাগরিক সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
এ ধরনের আক্রমণ নতুন নয়। ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পালাগানের আসরে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রিতা দেওয়ান। একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শরীয়ত সরকার নামের আরেক বয়াতি।
অধ্যাপক ইউনূস সরকারের অধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গত বছরের ২৫ নভেম্বর যশোরে দুই দিনব্যাপী সাধুসংঘের বাউলগানের আয়োজন ভণ্ডুল হয় (ইত্তেফাক, ২৬ নভেম্বর ২০২৪)।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় সংগীতানুষ্ঠান বন্ধ করে বাদ্যযন্ত্র জব্দ করে পুলিশ (ডেইলি স্টার, ৯ জানুয়ারি ২০২৫)। ফেব্রুয়ারিতে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে প্রয়াত বাউল রশিদ সরকারের সাধুর মেলা স্থানীয়দের বাধায় বাতিল হয় (বিডিনিউজ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
প্রশ্ন উঠছে—স্বৈরশাসনের পতন ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরও কেন এই দেশ এখনও সবার হয়ে উঠছে না? নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বেও কেন ভিন্নমত বা আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক শিল্পচর্চাকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না?
এই উপমহাদেশে সুফিবাদ, মানবতাবাদ ও ধর্মীয় উদারতার বিস্তারে বাউল–ফকিরগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অথচ তাঁদের সংগীতচর্চা বন্ধে সক্রিয় একটি গোষ্ঠী বারবার হামলা ও ভয়ভীতি সৃষ্টি করছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাউল-সাধুদের আধ্যাত্মিক ও উপমামূলক ভাষা না–বুঝে “ধর্মীয় অনুভূতি”কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তাঁদের টার্গেট করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মাজারে হামলা, সুফি গায়ক ও বাউলদের বিরুদ্ধে মব সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অনেক ভিডিওতে দেখা যায়, শিল্পীদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ স্লোগান, হামলা, তাড়াহুড়ো করে মামলা এবং আটক।
একজন শিল্পীর গানকে কেন্দ্র করে সামাজিক উত্তেজনা ও সহিংসতা তৈরি হওয়া দেশের জন্য অশনি সংকেত। শিল্পী–সাধকদের নিরাপত্তা না থাকলে বহুমত ও বহুধারার সাংস্কৃতিক চর্চা সংকুচিত হবে। যে দেশটির পরিচয় বহুবর্ণের সংস্কৃতিতে, সেই দেশেরই মূলধারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সরকারি প্রচারণা পেজে নিয়মিত সাংস্কৃতিক ইতিবাচক উদ্যোগের প্রচার চললেও মাঠপর্যায়ে বাউল-বয়াতিদের ওপর গ্রেপ্তার ও হামলাজনিত ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ যদি সত্যিকারের সবার দেশ হতে চায়, তবে সবার জন্য সমান নিরাপত্তা, জবাবদিহি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলতা ছাড়া সাম্প্রতিক উগ্রবাদী প্রবণতা ঠেকানো সম্ভব নয়।