ক্লাইমেট ফিন্যান্স: প্রতিশ্রুতির 'ভিক্ষার ঝুলি' নয়, দূষণকারীদের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা চাই
ডেস্ক রিপোর্ট
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৫
জাতিসংঘের ৩০তম জলবায়ু সম্মেলনের (কপ৩০) প্রথম সপ্তাহ যখন শেষ হলো, তখন আলোচনার টেবিলে একটি বিষয় স্পষ্ট- জলবায়ু অর্থায়নের বর্তমান মডেলটি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। আমরা, জলবায়ু সংকটের সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো, আর প্রতিশ্রুতির 'ভিক্ষার ঝুলি' হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি নই। আমাদের এখন যা প্রয়োজন, তা হলো একটি স্বয়ংক্রিয়, নির্ভরযোগ্য এবং ন্যায্য অর্থায়ন ব্যবস্থা। আর সেই সমাধানের একটি উপায় হতে পারে 'সলিডারিটি লেভি' (Solidarity Levies) বা 'সংহতি কর'।
কপ৩০-এর প্রথম সপ্তাহে আমরা একটি ঐতিহাসিক কিন্তু হতাশাজনক মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছি। বহুল প্রতীক্ষিত 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিল থেকে অর্থছাড়ের জন্য মাত্র ২৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রাথমিক প্রস্তাবনা আহ্বান করা হয়েছে (বার্বাডোস ইমপ্লিমেন্টেশন মোডালিটিস)। বৈশ্বিক চাহিদার তুলনায় এই অঙ্কটি একটি নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে একটি মাঝারি মানের ঘূর্ণিঝড়ও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর চেয়ে অনেক বেশি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে যায়। জলবায়ুজনিত কারণে প্রতি বছর আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এই বিশাল চাহিদা এবং নামমাত্র তহবিলের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল তফাৎ, তা পূরণে বর্তমান ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অক্ষম।
বর্তমান অর্থায়ন ব্যবস্থাটি মূলত "প্লেজ-ভিত্তিক" বা প্রতিশ্রুতি-নির্ভর। এর মানে হলো, উন্নত দেশগুলো সম্মেলনে এসে বড় বড় অঙ্কের অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেই টাকা কবে পাওয়া যাবে, আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। কোনো দেশের সরকার পরিবর্তন বা অর্থনৈতিক সংকটের অজুহাতে সেই প্রতিশ্রুত অর্থ আর কখনোই ক্ষতিগ্রস্ত দেশের হাতে পৌঁছায় না।
এটি একটি অগ্রহণযোগ্য, অকার্যকর এবং অসম্মানজনক ব্যবস্থা। জলবায়ু সংকট আমরা তৈরি করিনি; এটি একটি ঐতিহাসিক অবিচার। এই অবিচারের প্রতিকারের জন্য আমাদের "দান" বা "সহায়তা" নয়, আমাদের প্রয়োজন "ন্যায়বিচার" এবং "ক্ষতিপূরণ"।
প্রয়াত ড. সেলিমুল হক ঠিক এই কথাটিই আমাদের শিখিয়ে গেছেন। তিনি আমৃত্যু বলে গেছেন, “জলবায়ু অর্থায়ন কোনো সাহায্য বা দয়া (Aid) নয়, এটি হলো দূষণকারীদের দায়বদ্ধতা (Liability)। যারা সমস্যা তৈরি করেছে, সমাধান করার খরচ তাদেরই দিতে হবে।” আজ তার সেই দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই আমরা বলছি- প্রতিশ্রুতির দিন শেষ, এখন আমাদের পাওনা বুঝে নেওয়ার সময়।
ছবি: সংগৃহীত কপ৩০-এর ষষ্ঠ দিনের আলোচনায় উঠে আসা 'সলিডারিটি লেভি'র প্রস্তাবটি তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনো দান বা ভিক্ষা নয়; এটি ড. হকের সেই "দূষণকারী পরিশোধ করবে" (Polluter Pays Principle) নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি স্বয়ংক্রিয় কর ব্যবস্থা।
এর মূল ধারণাটি অত্যন্ত সহজ: যে খাতগুলো বিশ্বব্যাপী জলবায়ুকে দূষিত করে বিপুল মুনাফা অর্জন করছে, অথচ এখন পর্যন্ত খুব সামান্যই কর দিয়েছে, তাদের ওপর একটি আন্তর্জাতিক কর আরোপ করা।
এই আলোচনায় (ফ্রান্স, কেনিয়া ও বার্বাডোজের নেতৃত্বে গঠিত 'গ্লোবাল সলিডারিটি লেভি টাস্কফোর্স' অনুযায়ী) পাঁচটি প্রধান খাতকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে:
১. বিমান চলাচল (Aviation): আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের ওপর, বিশেষ করে ধনী যাত্রীদের 'প্রিমিয়াম' (বিজনেস বা ফার্স্ট ক্লাস) টিকিটের ওপর একটি নির্দিষ্ট লেভি আরোপ করা।
২. সামুদ্রিক জাহাজ (Shipping): বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত জাহাজগুলো যে জ্বালানি ব্যবহার করে, তা প্রায় করমুক্ত। এই বিশাল নিঃসরণকারী খাতের ওপর আন্তর্জাতিক কর আরোপ করা।
৩. জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি (Fossil Fuel Exports): যে কোম্পানিগুলো তেল, গ্যাস এবং কয়লা উত্তোলন করে এই সংকট তৈরি করেছে, তাদের রপ্তানির ওপর একটি ক্ষুদ্র 'সংহতি কর' বসানো।
৪. আর্থিক লেনদেন কর (Financial Transaction Tax - FTT): বৈশ্বিক শেয়ার বাজার এবং বন্ডের বিশাল লেনদেনের ওপর একটি অত্যন্ত নগণ্য হারের (যেমন ০.১%) কর আরোপ করা।
৫. অতি-ধনীদের ওপর সম্পদ কর (Tax on Extreme Wealth): অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১% ধনী মানুষ দরিদ্রতম ৬৬% মানুষের চেয়েও বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। তাই এই অতি-ধনীদের বিপুল সম্পদের ওপর একটি ন্যায্য কর আরোপ করা জলবায়ু সুবিচারের অংশ।
এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর নির্ভরযোগ্যতা (Predictability)। এটি কোনো দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বা বাজেট অধিবেশনের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যা প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরাসরি 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিলে জমা করবে।
এর ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে পারবে। আমরা জানবো যে, পরবর্তী দুর্যোগের পর ঘর মেরামতের জন্য আমাদের কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।
কপ৩০-এর দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত সপ্তাহে আমাদের, অর্থাৎ গ্লোবাল সাউথের প্রতিনিধিদের, এই দাবিটিই সর্বোচ্চ স্বরে তুলে ধরতে হবে। প্রতিশ্রুতির ফাঁপা বুলিতে আর একটি দিনও অপচয় করার সময় আমাদের হাতে নেই। বেলেম থেকে বিশ্বকে অবশ্যই এই বার্তা দিতে হবে যে, জলবায়ু অর্থায়ন কোনো চ্যারিটি বা দান নয় - এটি আমাদের অধিকার। আর সেই অধিকার আদায়ে 'সলিডারিটি লেভি' হতে পারে আমাদের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার।
লেখক: আল মামুন রাকিব- (ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোকাল - লাল সবুজ সোসাইটি, ইয়ুথ রিপ্রেজেন্টেটিভ - ICCCAD)