প্রতিদিন দ্বিগুণ হারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। অথচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেয়া পরিসংখ্যানে প্রকৃত তথ্যের গোপন করে এক তৃতীয়াংশের কথা জানানো হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে আসা ডেঙ্গুতে এক জনের মৃত্যু ও ৮৯৬ জন আক্রান্তের সংখ্যা জানানো হয়। অথচ ৩৫টি হাসপাতাল কোন তথ্য জানায়নি বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়।
চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ২৮ হাজার ৪৪৩ জন আর মৃত্যু ১৫৬ জন। শুধু রাজধানীতে মৃত্যু ১১৪ জন আর আক্রান্ত ১০ হাজার ৮০৪ জন। বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তদের তথ্য দেয়া হয় না। এমনকি, কোন কোন সরকারি হাসপাতাল থেকেও নিয়মিত তথ্য দেয় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। ঢাকার সাতটি সরকারি হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে ডাক্তার, নার্সদের অন্য রোগীদের সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। এমনকি সুচিকিৎসার অভাবে রোগীর মৃত্যু খবরও পাওয়া গিয়েছে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতে যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডাক্তার নার্সদের রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে পদায়ন শুরু হয়েছে। একইভাবে ঢাকার বাইরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও এ পদায়ন শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে থেকে কথা বলা আর সরেজমিনে দিয়ে দেখা এক দৃশ্য নয়। নিয়ন্ত্রণের নামে অন্ধকারে ঢিল মারার মত অবস্থা হয়েছে। রাস্তায় গলাবাজি না করে মশা নিয়ন্ত্রণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, সামনে ডেঙ্গু মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। কারণ সামনে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হবে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় এডিস মশার বংশ বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা। তারা বলেন, শত্রু শতভাগ চিহ্নিত এবং হাতের কাছে। তাকে নিধন করা না গেলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই মশা নিধন করার ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা, যার কাজ তাকে দূরে রাখা, সঠিক পরিকল্পনা না করাই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করার জন্য দায়ী।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অভিজ্ঞ জনবল তৈরি ও প্রশিক্ষণের জন্য জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেসময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও যুক্তরাজ্যের লিভারপুল ইউনিভার্সিটর সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর করেছেন। যাতে করে ওই দুই প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে গবেষণার ফলাফল আদান প্রদান অভিজ্ঞ জনবল তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতি বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে ১৭৫ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বের হচ্ছে। অথচ তাদেরকে মশক নিধন কার্যক্রমে রাখা হয়নি। এ প্রতিষ্ঠানটি ও আইইডিসিআর করোনা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অতি সম্প্রতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুই সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয। ওই সভায় মশক নিধন নিয়ে সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা বলায় তখনই বিশেষজ্ঞরা উপলব্ধি করতে পারেন মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন নিয়ে প্রকৃত কোন ধারনাই নাই। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের উক্ত কর্মকর্তার কথা শুনে মনে হলো তিনি মশা নিধনে প্রকতৃপক্ষে কিছুই জানেন না। যার কাজ তাকে দিয়ে না করালে জাতির দুর্দশা শেষ হবে না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, চিহ্নিত শত্রুকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। কিন্তু তা নিয়ে উদাসীনতা মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, চিকিৎসকদের কাজ হলো চিকিৎসা দেয়া, মশা মারার কাজ আমাদের না। এ প্রসঙ্গে নিপসম এর কীটতত্ববিদ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোলাম ছারোয়ার বলেন, যার কাজ তাকে না করালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াই স্বাভাবিক।