বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার—সরকারি মোট ঋণ ২১ ট্রিলিয়ন টাকা ছাড়িয়েছে। রাজস্ব আয় কম, ব্যয় বেশি—ফলে বাড়ছে ঋণের বোঝা। শুধু ঋণই নয়, বাড়ছে সুদ পরিশোধের চাপও। আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের সতর্কবার্তা এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কী আছে এ ঋণের পেছনের বাস্তব চিত্রে? কী বলছে পরিসংখ্যান ও বিশেষজ্ঞরা?
অর্থ বিভাগের সদ্য প্রকাশিত ঋণ বুলেটিন বলছে—২০২৪ সালের জুন শেষে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৪৪ ট্রিলিয়ন টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। দীর্ঘদিনের রাজস্ব ঘাটতি এবং বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধিই ঋণের এই দ্রুত বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
ঋণের এই বিশাল অঙ্কের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৯ দশমিক ৪৯ ট্রিলিয়ন টাকা—মোট ঋণের প্রায় ৪৪ শতাংশ। পাঁচ বছর আগেও যেখানে বৈদেশিক ঋণ ছিল সাড়ে চার ট্রিলিয়নের মতো, সেখানে এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি। অভ্যন্তরীণ ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৯৫ ট্রিলিয়ন টাকায়—যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার কার্যত উন্নয়ন ব্যয়ে স্বনির্ভর হতে পারছে না। সিপিডির অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্ত না থাকায় সরকারকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক—উভয় উৎস থেকেই ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে একদিকে ঋণের বোঝা বাড়ছে, অন্যদিকে পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বিদেশি ঋণের বেশিরভাগই এখন কঠোর শর্তযুক্ত—উচ্চ সুদ, স্বল্প গ্রেস পিরিয়ড এবং দ্রুত পরিশোধের বাধ্যবাধকতা যুক্ত।
ঋণের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদ পরিশোধের ব্যয়ও দ্রুত বাড়ছে। গত অর্থবছরে সরকার সুদ হিসেবে পরিশোধ করেছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা—যা আগের বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। দেশীয় ঋণের সুদ ১৬ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ ২১ শতাংশ বেড়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ পরিশোধের পরিমাণ তো এক বছরে ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই ঋণবৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন— মহামারির পর উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো থেকে পাওয়া বাজেট সহায়তা এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রো রেল ও মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর জন্য করা ব্যাপক ব্যয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে সরকারি ঋণের ধারা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। রাজস্ব সংগ্রহে ধীরগতির কারণে রাজস্ব বাজেটে কার্যত কোনও উদ্বৃত্ত নেই, যার ফলে সরকার উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক— উভয় ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। 'ফলস্বরূপ সামগ্রিক ঋণ বাড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের হারও এখন বেশি। একইসঙ্গে বিদেশি ঋণে অনুদানে খুব কম থাকে বা কোনো অনুদান থাকেই না। আর ঋণের বেশির ভাগ কঠিন শর্তের-উচ্চ সুদ, পরিশোধের সময় কম আর স্বল্প সময়ে(গ্রেস পৃয়ড) অর্থ পরিশোধ শুরু করতে হয়। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতি দেশের ঋণ পরিশোধের চাপ তীব্রভাবে বাড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ঋণের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এডিবির মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে দ্রুত। আইএমএফের সর্বশেষ ঋণ স্থায়িত্ব বিশ্লেষণে বাংলাদেশকে ‘নিম্ন ঝুঁকি’ থেকে নামিয়ে ‘মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবং ঋণ পরিশোধের হার বাড়াই এর প্রধান কারণ।
এই ঝুঁকি সামাল দিতে আইএমএফ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে একটি সীমা বেঁধে দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে দেশ সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিতে পারবে। ঋণ গ্রহণের প্রতিটি ধাপ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ করবে আইএমএফ।
ঋণ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জ কাটাতে সরকার এখন একটি সমন্বিত ডেট ম্যানেজমেন্ট অফিস—ডিএমও গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ পরামর্শে গঠিত এই সংস্থা সরকারের সব ধরনের ঋণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন, ঋণ গ্রহণ পরিকল্পনা এবং ডাটাবেজ একীভূত করার কাজ করবে। লক্ষ্য—অকার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনার জটিলতা কমানো এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আয় না বাড়ালে ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তুলনায় বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ এখনো অর্ধেকেরও কম। রাজস্ব প্রশাসন শক্তিশালী করা, প্রযুক্তি বাড়ানো, কর ফাঁকি কমানো এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাছাইয়ে কঠোরতা এই মুহূর্তে দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
২১ ট্রিলিয়ন টাকার ঋণ শুধু একটি সংখ্যা নয়—এটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি সতর্ক সংকেত। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সামনে আরও বড় আর্থিক চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।