বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে যাঁরা ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম শাহ্ আবদুল হান্নান। ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) প্রবর্তনের মতো একটি দুঃসাহসিক উদ্যোগের নেপথ্য নায়ক ছিলেন এই গুণী মানুষটি। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর কীর্তিগাথা খুব বেশি প্রচার পায়নি।
আমার প্রথম পরিচয় শাহ্ আবদুল হান্নানের সঙ্গে ঘটে সেই সময়েই, যখন বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সুপারিশে অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো ভ্যাট চালু করে। সেই সময় তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য ছিলেন এবং নিজ উদ্যোগেই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে গিয়ে ভ্যাট সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন ক্লান্তিহীন আত্মনিবেদন নিয়ে। এই উদ্যম না থাকলে দেশে ভ্যাট চালু করাই হতো দুঃসাধ্য।
যদিও ভ্যাট প্রবর্তনের কৃতিত্ব অনেকসময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নামেই উচ্চারিত হয়, বাস্তব কাজের নেতৃত্বে ছিলেন শাহ্ আবদুল হান্নান। আমি নিজ চোখে দেখেছি, কীভাবে তিনি প্রায় ২০০ জন কর্মকর্তাকে ভ্যাটের মৌলিক দিকগুলো ব্যাখ্যা করে একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি করেন। তাঁর বক্তৃতা ছিল গুছানো, যুক্তিপূর্ণ ও স্পষ্ট—শিক্ষণীয় এক দৃষ্টান্ত।
সোনালী ব্যাংকে চেয়ারম্যান থাকাকালীন একদিন শাহ্ আবদুল হান্নান আমাকে ফোন করে শুধু একটি বিষয়ে অনুরোধ করেছিলেন—‘চেয়ারম্যান, এমডি, বোর্ডের কক্ষ তো আছে, কিন্তু নামাজের ঘর নেই।’ এতটা ধর্মনিষ্ঠ ও মূল্যবোধসম্পন্ন চিন্তা আমি অন্য কারো মধ্যে দেখিনি।
সেই কথায় প্রভাবিত হয়ে আমার পিএস-এর রুমটি খালি করে সেখানে নামাজের ব্যবস্থা করি, যা পরবর্তীতে স্থায়ী হয়। কেউ সুপারিশ করেন লোনের জন্য, কেউ পদোন্নতির জন্য—শাহ্ আবদুল হান্নান চেয়েছিলেন কেবল নামাজের জায়গা। এ থেকেই তাঁর চরিত্র ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা স্পষ্ট।
সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তাঁর সঙ্গে বহুবার অংশ নিয়েছি। সংক্ষিপ্ত ভাষায় তিনি তুলে ধরতেন জাতীয় সমস্যা ও সমাধানপথ। তিনি শুধুই একজন আমলা ছিলেন না, ছিলেন চিন্তাবিদ, আদর্শিক নেতা। তরুণদের ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার পথে আহ্বান জানাতে লেখালেখিতেও ছিলেন সক্রিয়। একজন বহুমাত্রিক মানুষ—সাংবাদিকতা, বক্তৃতা, নীতিনির্ধারণ—সবখানেই ছাপ রেখেছেন।
তাঁর শুদ্ধাচার, সততা ও উদ্যম—এই গুণগুলো আজকের প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয়। তিনি কখনো ব্যক্তিস্বার্থে মাথা নত করেননি। জাতীয় কল্যাণে আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন।
এমন একজন মানুষ, যিনি দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে পথিকৃত, ধর্মীয় মূল্যবোধে অটল এবং ব্যক্তিত্বে অনন্য—তাঁর কি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্য নয়?
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শাহ্ আবদুল হান্নানকে মরণোত্তর জাতীয় পুরস্কার ও শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত। এতে কেবল তাঁর প্রতি সম্মান দেখানো হবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মও সঠিক মূল্যবোধ ও নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে তাঁকে মনে রাখবে।আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।
লেখক : সাবেক সচিব, সঙ্গীতজ্ঞ