কুষ্টিয়া–পাবনা–নাটোর জুড়ে বিস্তৃত পদ্মার বিস্তৃত চরাঞ্চল যেন এখন আর নদীর প্রাকৃতিক ভূমি নয়—এটি রূপ নিয়েছে বালু উত্তোলনের এক বিশাল অঘোষিত খনিতে। ভোর হতেই নদীর বুকজুড়ে সারি সারি নৌকা ও বাল্কহেডের উপস্থিতি জানান দেয়—এখানে পানি নয়, দিনরাত উঠছে শুধু বালু। আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী তিন প্রতিষ্ঠান—মেসার্স বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স আনোয়ারুল হক মাসুম—বছরের পর বছর ধরে পদ্মার বিভিন্ন অংশে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর দাবি, এসব প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নিজস্ব সশস্ত্র ক্যাডার দল। নদীর ঘাট থেকে উত্তোলিত বালু তোলা, পরিবহন ও বাজারজাত—সবকিছুই চলে তাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে নদী যেন পরিণত হয়েছে এক ‘ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যে’।
অথচ কুষ্টিয়া অঞ্চলে পদ্মার মূল চরে বৈধ ইজারা আছে মাত্র একটি—লালপুরের দিয়ার বাহাদুরপুর বালুমহাল, যার ইজারাদার মেসার্স মোল্লা ট্রেডার্স। প্রায় ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, বৈধভাবে ব্যবসা করতে গিয়ে তাঁকে নিয়মিত লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে।
শহিদুল ইসলামের অভিযোগ, অবৈধ বালু উত্তোলনে জড়িত চক্রের সদস্যরা একাধিকবার তাঁর ঘাটে ভাঙচুর চালিয়েছে, টিকিট কাউন্টার ও রান্নাঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘাটে আসা নৌকার মাঝিদেরও মারধর ও লুট করা হয়েছে। তাঁর ভাষায়, বৈধভাবে ব্যবসা করলে প্রতিদিনই আমাদের হয়রানির মুখে পড়তে হয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোই যেন এখানে অপরাধ।
অন্যদিকে নদীতে বৈধ ইজারা ছাড়া আর কেউ বালু তুলতে পারবে না বলে বিআইডব্লিউটিএ ১০ নভেম্বর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে লিখিত নির্দেশনা দেয়। তবে চিঠি পাঠানোর কিছুদিনের মধ্যেই নদীতে আবারও শুরু হয় পুরোনো চিত্র—গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটায় বালু উত্তোলনকারী নৌকাগুলো। নৌ–পুলিশের টহল নৌকা কাছে এলেই এগুলো দ্রুত সরে পড়ে; হাতে–নাতে কাউকে ধরা যায় না।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জানান, পদ্মা নদীতে বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। অবৈধ উত্তোলন দেখলেই অভিযান পরিচালনা করা হবে, বলেন তিনি। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে জেলা পুলিশ সুপার–এর কাছ থেকেও। তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএর চিঠি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, কাগজে–কলমে অভিযান চললেও বাস্তবে বালুখেকোদের নেটওয়ার্ক এত শক্তিশালী যে, তারা প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনফুট বালু তুলছে। সামান্য নজরদারি বাড়লেই তারা একদিন থেমে যায়, আবার পরদিন আগের চেয়েও বেশি উৎসাহে কাজে নেমে পড়ে।