পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রায় দুইশো বছর পুরনো কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের ইমামতিতে সকাল দশটায় এ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। রীতি অনুযায়ী ঈদের জামাতের তিন মিনিট আগে তিনটি ও এক মিনিট আগে একটি শটগানের গুলির আওয়াজের পর জামাত শুরু হয়।
ঐতিহাসিক এ জামাতে তিন লাখের বেশি মুসুল্লি অংশ নিয়েছেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সকাল ৯ টার পর পুরো ৭ একরের ঈদগাহ প্রান্তর কানায় কানায় ভরে যায়। এরপর মাঠে জায়গা না পেয়ে আশেপাশের বাড়িঘর ও রাস্তা ঘাটে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করেন ্মুসল্লীরা।
নামাজ পড়তে আসা মুসল্লীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ জামাতে অংশগ্রহণ করতে এসেছেন শুধুমাত্র নাজাতের আশায়।
কেউ কেউ বলছেন, এতো বড় লোকসমাগমের দোয়া আল্লাহ কারো না কারো উছিলায় কবুল করে নেন, তাই তারা এখানে জামাত পড়তে এসেছেন।
স্থানীয় মুসল্লী আকাশ ইসলাম জানান, 'আমরা ছোটবেলা থেকেই এ মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করে আসছি, এখানে নামাজ না পড়লে আমাদের মনে শান্তি লাগে না, এখানে নামাজ না পড়লে আমাদের ঈদ সম্পূর্ণ হয় না। তাই প্রতিবারই এ ঈদগাহে নামাজ আদায় করি। আর এ মাঠ তো আমাদের গর্ব, পুরো এশিয়া এমনকি বিশ্বেরও গর্ব।'
নামাজ শেষে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনার পাশাপাশি মহান আল্লাহর কাছে মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
দীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পর মুসল্লীরা নিজেদের যেন বাকি এগারো মাস আল্লাহর পথে থাকতে পারেন সেই দোয়াও করেন। রহমতের মাস রমজান শেষে খুশির ঈদ এলেও তাৎপর্যপূর্ণ এ মাসটি দ্রুতই শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেক মুসল্লী কান্নায় ভেংগে পড়েন।
ঐতিহাসিক এ মাঠে এবারের ঈদুল ফিতরের জামাতটি ১৯৬ তম ঈদের জামাত ছিলো। প্রায় দুইশো বছর পুরনো ঐতিহ্যেবাহী এ মাঠের ঈদের জামাতকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নেওয়া হয়।
২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরের দিনে অপ্রত্যাশিত হামলার বিষয়টি মাথায় রেখে এবারও মাঠে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা ঘরে ফেরায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ।
ঈদগাহে প্রবেশের আগে একজন মুসুল্লীকে তিন থেকে পাচঁটি নিরাপত্তা গেইট ভেদ করে মাঠে প্রবেশ করতে হয়েছে। এছাড়াও গরমের বিষয়টি মাথায় রেখে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মুসল্লীদের বিনামূল্যে পানি বিতরণ করা হয়।
নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে পুলিশের পাশাপাশি দ্বায়িত্ব পালন করেন ডিবি, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন, আনসার ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়াও হেলিকপ্টারের দ্বারা নিয়মিত টহল ও চারটি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে আগত মুসল্লীদের গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে র্যাব।
মাঠের ভেতর ও বাইরে ছিল ৬৪টি সিসিটিভি ক্যামেরা আর ছয়টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে আগত মুসল্লীদের নিরাপত্তা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে র্যাব ও পুলিশ।
নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে মুঠোফোন, ছাতা বা কোনো ধরনের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শুধু পাতলা জায়নামাজ নিয়ে নামাজ আদায় করতে আসেন মুসল্লিরা। নিষেধ ছিল দেশলাই বা লাইটার সঙ্গে না রাখার। মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিদার্থে ভৈরব ও ময়মনসিংহ থেকে দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়ায় প্রথম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈশা খাঁর বংশধর দেওয়ান হয়বত খাঁ কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর এ ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে মাঠের জমির পরিমাণ আরও বাড়ানো হয়। দেওয়ান মান্নান দাদ ছিলেন হয়বত খাঁর বংশধর। হয়বত খাঁ ছিলেন ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর। যে কারণে শুরু থেকে এ মাঠের জমিদারির একটা ঐতিহ্য রয়েছে। এটা তৎকালীন জমিদারের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ছিল বলে ইতিহাসবিদদের কাছে জানা যায়।
কিশোরগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে শোলাকিয়া মাঠ নিয়ে দুটি জনশ্রুতির বর্ণনা রয়েছে। এর একটি হলো, মুঘল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল শ লাখ টাকা। মানে এক কোটি টাকা। কালের বিবর্তনে শ লাখ থেকে বর্তমান শোলাকিয়া হয়েছে। আরেকটি বর্ণনায় আছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে এটি শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।