গত বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) সন্ধ্যায় আচমকা এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ভারত সব ধরনের ‘নন-বাসমতি হোয়াইট’ চালের রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক খাদ্যবাজারে আতঙ্কের স্রোত নেমে এসেছে। বিশ্বের বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশের এমন সিদ্ধান্তে যারা সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়বে, তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকে আশঙ্কা করছেন।
ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান শুরু কিংবা সম্প্রতি ‘ব্ল্যাক সি খাদ্যচুক্তি’ থেকে মস্কো নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার পর যেভাবে বিশ্ববাজারে গমের দাম হু হু করে বেড়েছে, ঠিক সেভাবেই ভারতের এই সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চালের দামও মারাত্মকভাবে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারত সরকার প্রধানত যে কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হলো মাত্র আট-নয় মাস পরে দেশে সাধারণ নির্বাচন, তার আগে চালের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাক এটা তারা কিছুতেই চাইবে না। এদিকে বাংলাদেশেও আর মাত্র মাস চারেক পরেই নির্বাচন, সেখানেও চালের দাম এখন বেড়ে গেলে সরকারের জন্য তা খুবই অস্বস্তিকর হবে।
রফতানির জন্য মুম্বাই বন্দরে জড়ো করা চালের বস্তা বাণিজ্যিক ঋণ-বিমা সংস্থা কোফেস-এর অর্থনীতিবিদ ইভ বার সিএনবিসি চ্যানেলকে বলেছেন, ‘ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের যোগান মারাত্মকভাবে কমে যাবে। এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ আর নেপাল, কারণ তারাই ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি চাল আমদানি করে।’
ভারতের রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বি ভি কৃষ্ণা রাও বার্তা সংস্থাকে রয়টার্সকে বলেছেন, ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া যেভাবে বিশ্বের গম বাজার তছনছ করে দিয়েছিল, এবারে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর গতিতে বিশ্বের চালের বাজারে আগুন লাগবে। চালের ক্রেতা দেশগুলোর জন্য এই সিদ্ধান্ত খুবই যন্ত্রণাদায়ক হবে, কারণ তাদের এখন অন্য কোনও জায়গা থেকেই শিপমেন্ট আনার উপায় নেই।’
গ্রো-ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্টের প্রচ্ছদ
বিশ্বে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ে গবেষণা করা ‘গ্রো ইন্টেলিজেন্স’–এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল যে ভারত যে কোনও মুহুর্তে বিশ্বে চালের রফতানি বন্ধ করে দিতে পারে। তারা ওই রিপোর্টে আরও বলেছিল, ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি চাল আমদানি করে বাংলাদেশ, নেপাল, চীন ও আফ্রিকার দেশ বেনিন। এই চারটি দেশেই (সেই সঙ্গে আফ্রিকার আরও কিছু দেশে) নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করেছিল ‘গ্রো ইন্টেলিজেন্স’।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-বিষয়ক ডেটাবেজ ‘কমট্রেড’-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালেও বাংলাদেশ ভারত থেকে প্রায় ২৫৭ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করেছে। তার আগের বছর (২০২১) এই পরিমাণ ছিল ৯০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে ক্রমশ স্বনির্ভর হয়ে ওঠায় ভারত থেকে চাল আমদানির পরিমাণ হয়তো কমছে, কিন্তু এই নির্ভরশীলতা এখনও পুরোটা কাটিয়ে ওঠেনি। যে কারণে ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে ভারত যে সব ধরনের চালের রফতানি নিষিদ্ধ করেছে তা নয়। বাসমতি নয়, এমন সাদা চাল (আতপ-সহ) এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ছে। ছাড় পেয়েছে শুধু বাসমতি ও রফতানিযোগ্য সিদ্ধ চাল।
গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ বছরে দেশে মৌসুমী বৃষ্টিপাত দেরিতে হয়েছে, কিন্তু প্রবল বর্ষণ হয়েছে। এতে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং গত এক মাসেই খুচরা বাজারে চালের দাম ৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর গত এক বছরের পরিসংখ্যান হিসেবে নিলে দেখা যাবে খুচরা বাজারে চালের দাম ১১.৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।
‘এই পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য বৃদ্ধিতে রাশ টানতে এবং বাসমতি নয়, এমন সাদা চালের পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করতে সরকার তাদের রফতানি নীতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে’, বলা হয়েছে ওই বিবৃতিতে।
তবে গত বছরও ভারত যে ২২ মিলিয়ন টাল বিদেশে রফতানি করেছিল, তার মধ্যে ১০ মিলিয়নে টনেরও বেশি ছিল এই ধরনের ‘নন-বাসমতি’, ‘হোয়াইট’ চাল। ফলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ভারত যা চাল রফতানি করে থাকে তার অর্ধেকই এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ভারত সরকারের বিজ্ঞপ্তি
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে কোনও বিশেষ দেশকে নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ মনে করছেন বিশেষ ব্যবস্থায় বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশে চাল রফতানির অনুমতি দেওয়া হতে পারে।
কৃষি অর্থনীতি নিয়ে রিপোর্ট করেন মুম্বাইয়ের সাংবাদিক জয়শ্রী ভোঁসলে। তিনি যেমন বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বরেও আমরা দেখেছি জি-টু-জি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) ডিলের আওতায় ভারতের দুটি সমবায় সংস্থাকে বাংলাদেশে ২ লাখ টন চাল রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ভারতের বেসরকারি ট্রেডারদের কাছ থেকেও বাংলাদেশ কিনেছিল আরও ৫০ হাজার টন চাল।’
জয়শ্রী ভোঁসলে মনে করছেন, যেহেতু দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো এবং বিশেষ করে মাস দেড়েকের মধ্যেই শেখ হাসিনা ভারত সফরেও আসছেন – তাই বাংলাদেশে সব ধরনের চাল রফতানি অব্যাহত রাখার জন্য কোনও ‘ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ’ নেওয়াই হতে পারে।