কুষ্টিয়ার খাজানগর দেশের অন্যতম বড়ো চাল মোকাম। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ধান–চালের লেনদেনে মুখর এই বাণিজ্যকেন্দ্র যেন এক অদৃশ্য সিন্ডিকেটের দখলে।
সনাতন মিলগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়লো— একদিকে শ্রমিকদের ক্লান্ত হাত, অন্যদিকে মুনাফার সিংহভাগ কুক্ষিগত করে নিচ্ছে কিছু স্বয়ংক্রিয় অটো রাইস মিল। চালের দামে এমন তুঘলকি কাণ্ড চলছে যে, উৎপাদন ঘরে থাকা কৃষক বা সনাতন মিল মালিক কেউই এর সুবিধাভোগী নন— বরং পুরো সিস্টেম যেন সাজানো কিছু নির্দিষ্ট মালিকের লাভের জন্য।
বাজুমারা রাইস মিল প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মণ ধান ভাঙানো হয় এখানে। হিসাব কষে দেখা যায়, সনাতন বা হাসকিং মিলে মিনিকেট চালের উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ৫৭ টাকা। সেখান থেকে মাত্র ৫৯ টাকায় চাল তুলে নিচ্ছেন স্বয়ংক্রিয় মিল মালিকরা। এই ২ টাকার গ্যাপে সনাতন মিল মালিকদের লাভ বলতে গেলে নেই বললেই চলে। কিন্তু এখানেই শুরু আসল খেলা। অটো মিলগুলোতে পালিশ, বাছাই আর ব্র্যান্ডিংয়ের নামে খরচ বাড়ানো হয় আরও ৪ টাকা, অর্থাৎ মোট খরচ দাঁড়ায় ৬৩ টাকা। অথচ সেই চাল বের হয় বাজারে ৭২–৭৩ টাকায়। যা খরচের চেয়ে প্রতি কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেশি।
প্রশ্ন উঠছে— এই অতিরিক্ত টাকা কার পকেটে যাচ্ছে? স্বয়ংক্রিয় মিলের পাশাপাশি খাজানগরে রয়েছে কমপক্ষে ২০০ সনাতন মিল, যেগুলো থেকেই আসে বিপুল পরিমাণ মিনিকেট চাল। কিন্তু সনাতন মিলগুলো কেবল কাঁচামাল সরবরাহকারী— লাভের বড়ো অংশ জমা হয় অটো মিল মালিকদের ঘরে। যেন শ্রম একের, মুনাফা অন্যের।
সনাতন মিল মালিকদের দাবি আরও উদ্বেগজনক। তারা বলছেন— অটো মিলগুলো আসল মিনিকেট চাল নয়, বরং সাথে ব্রি-২৮সহ মাঝারি মানের চাল মিশিয়ে নিজেদের মোড়কে বাজারজাত করছে। অর্থাৎ ভোক্তা কিনছেন মিনিকেট, কিন্তু আসলে হাতে পাচ্ছেন মিশ্রিত চাল। এতে তাদের উৎপাদন খরচ আরও কমে যায়, আর লাভের অঙ্ক দাঁড়ায় অস্বাভাবিক উচ্চতায়। প্রশ্ন হলো— ভেজাল মিশ্রণে মান নষ্ট হওয়ার দায় কে নেবে?
এক পাশে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল বাজুমারা মিল–সংলগ্ন এক অংশীদারের সাথে। তার কথায় ক্ষোভের ঝাঁজ স্পষ্ট।
আমরা রাত–দিন দাঁড়িয়ে থেকে উৎপাদন করি। ৫৯ টাকায় বিক্রি করি। তারা সামান্য পালিশ করে ৭৩ টাকায় তোলে। এটা তো সরাসরি ভোক্তার পকেট কাটা।
স্থানীয় কৃষি বিপণন কর্মকর্তাও বিষয়টি অস্বীকার করেননি। বরং অকপটে স্বীকার করলেন— সব খরচ মিলিয়েও মিনিকেট চালের পাইকারি দাম ৬৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ বাজারে যে দাম রাখা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং চরম মূল্য কারসাজির ফল। সরকারি একজন কর্মকর্তার মুখেই যখন এই স্বীকারোক্তি, তখন প্রশ্ন আরও তীব্র হয়— অবস্থার পরিবর্তনে উদ্যোগ কোথায়?
অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয় মিল মালিকদের বড়ো অংশ কোনোভাবেই দায় স্বীকার করতে চান না। তাদের যুক্তি—“বড়ো মিল নয়, কিছু ছোট অটো মিল মালিক এই কাজ করছে।” দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানো ছাড়া যেন আর কোনো বাস্তব প্রতিকার নেই তাদের কথায়। অথচ বাজার ঘুরে দেখা যায়— এই দাম বাড়ানোর চক্রে বড়ো মিল–ই বেশি লাভে আছে।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তার বক্তব্য হতাশাজনক। তিনি বলছেন— এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে তাদের দপ্তরের খুব বেশি করার সুযোগ নেই। আরও নিরাসক্ত প্রতিক্রিয়া আসে ভোক্তা অধিকার দপ্তর থেকেও। তারা জানালেন— সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তারা ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। অর্থাৎ অভিযোগ করতে হবে ভোক্তাকেই, কিন্তু ক্ষতি তো সেই ভোক্তারই— তাহলে অভিযোগ করবে কে?
অন্যদিকে, সনাতন মিল মালিকদের দেওয়া হিসাব বলছে— সরাসরি অটো মিলে উৎপাদিত মিনিকেট চালের খরচ সনাতন মিলের তুলনায় আরও কম হওয়া উচিত। কারণ, ৪০ কেজি ধান থেকে ২৬ কেজি চাল পাওয়া যায়, মিলের খরচসহ কুঁড়া ও খুদের বিক্রি হিসাব করলে উৎপাদন খরচ আরও কমে যায়, অটো মিলের রাইস ব্রান (৮ কেজি) বিক্রিতে যুক্ত হয় অতিরিক্ত ২৪০ টাকা, ফলে প্রকৃত উৎপাদন খরচ ৬৩ টাকারও কম। তাহলে বাজারে এত চড়া দাম কেন?
সবশেষে এসে তৈরি হয় একটাই প্রশ্ন, এ বাজারে কৃষক বঞ্চিত, সনাতন মিল বঞ্চিত, ভোক্তা বঞ্চিত— শুধু লাভবান অল্প কিছু স্বয়ংক্রিয় মিল মালিক। এই লুটপাটের খেলা বন্ধ হবে কীভাবে? আর এর দায় নেবে কে?